• মিউনিখে ফরাসি বিপ্লব! ইন্টারকে ৫ গোলে মাটি ধরিয়ে চ্যাম্পিয়ন পিএসজি, ৩২ বছর পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এল ফ্রান্সে
    আনন্দবাজার | ৩১ মে ২০২৫
  • প্রেস, প্রেস আর প্রেস! লুই এনরিকের প্যারিস সঁ জরমঁ (পিএসজি) এই তিন মন্ত্রেই জিতল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। জার্মানির মিউনিখের মাঠে ইটালির ইন্টার মিলানকে দাঁড় করিয়ে ইউরোপের সেরা ক্লাব হল তারা। ১৯৯৩ সালে ফরাসি ক্লাব মার্সেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছিল। সেটাই প্রথম। এত বছর সেটাই ছিল শেষ। ঘটনাচক্রে মার্সেই হারিয়েছিল মিলানেরই অপর ক্লাবকে (এসি মিলান)। তা-ও মিউনিখের মাঠেই। ৩২ বছর পর সেই জার্মানির মাঠেই রূপকথা লিখল পিএসজি। ইন্টারকে নিয়ে ছেলেখেলা করল পিএসজি। তাদের মাটি ধরিয়ে ৫-০ গোলে জিতল ফ্রান্সের ক্লাব। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালের ইতিহাসে এই প্রথম এত বড় ব্যবধানে কোনও দল জিতল। ইতিহাস তৈরি করলেন লুই এনরিকের ছেলেরা।

    প্যারিসের ক্লাবের কোচের দায়িত্ব নেওয়ার পর দলটাকে বদলে দিয়েছেন লুই এনরিকে। অতীতে বার্সেলোনার মতো দলের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন এনরিকে। তিনি জানেন, দলের থেকে সেরাটা বার করতে হলে কী দরকার? তাই দায়িত্ব নিয়ে সকলের আগে কিলিয়ান এমবাপেকে ছেড়ে দেন এনরিকে। তার আগে নেমার ও লিয়োনেল মেসিও ক্লাব ছেড়েছেন। জ্লাটান ইব্রাহিমোভিচ, রোনাল্ডিনহো, এডিনসন রাভানি, অ্যাঙ্খেল দি’মারিয়া, মেসি, নেমার, এমবাপে যা পারেননি সেটাই করে দেখালেন উসমান দেম্বেলে, আশরফ হাকিমিরা। এনরিকে বড় নামের পিছনে ছোটেননি। এই দলে তারকা সে রকম কেউ নেই। তিনি চেয়েছিলেন এমন একটা দল যা এক সুতোয় বাঁধা থাকবে। অভিজ্ঞতার পাশাপাশি তরুণ প্রতিভা তুলে আনতে চেয়েছিলেন। সেটাই তিনি করেছেন। পিএসজি-র এই দলে তাঁরাই খেলেন যারা কোচের প্রতিটা নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। সেটাই দেখা গেল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে।পিএসজি-র এই জয় রূপকথার থেকে কম নয়। গ্রুপ পর্বে বিদায়ের মুখে ছিলেন তাঁরা। নক আউটে উঠতে হলে শেষ ম্যাচে ম্যাঞ্চেস্টার সিটিকে হারাতেই হত তাদের। পেপ গুয়ার্দিওলার দলের বিরুদ্ধে প্রথমার্ধে ০-২ গোলে পিছিয়ে ছিল পিএসজি। সেখান থেকে স্বপ্নের প্রত্যাবর্তন। দ্বিতীয়ার্ধে চার গোল করে সেই ম্যাচ জেতার পর আর পিছন ফিরে তাকাননি এনরিকে। সামনে যে এসেছে, তাকে হারিয়ে এগিয়েছেন। রিয়াল মাদ্রিদকে হারানো আর্সেনালকে সেমিফাইনালের দুই পর্বে হারিয়ে ফাইনালের উঠেছেন। ফাইনালেও দাপট দেখিয়ে জিতল পিএসজি। দেখে মনে হচ্ছিল, লড়াই করতে নেমেছে তারা। ইউরোপের ফুটবল মানচিত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার লড়াই। ফ্রান্সের সেরা ক্লাব হলেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে না পারলে সেই কৌলিন্য পাওয়া যায় না। ২০২০ সালে ফাইনালে উঠে হারতে হয়েছিল। এ বার সেই কোলিন্য পেল তারা। পিএসজি-র এই জয় ইউরোপের ফুটবলে আরও এক ফরাসি বিপ্লব।

    ইন্টার মিলানও গোটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ভাল খেলেছে। সেমিফাইনালে বার্সেলোনার মতো ক্লাবকে সাত গোলের থ্রিলারে হারিয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে সেখানে ৮৭ মিনিট পর্যন্ত পিছিয়ে থেকেও জিতেছেন ডেঞ্জিল ডামফ্রিস, লাউতারো মার্তিনেসরা। কিন্তু ফাইনালে সেই ইন্টারকে খুঁজেই পাওয়া গেল না। তাঁদের অদৃশ্য থাকার নেপথ্যে পিএসজি-র কোচ এনরিকের মগজাস্ত্র। তিনি ভাল ভাবেই জানতেন ইন্টারের আক্রমণ শুরু হয় রক্ষণের শেষ স্তম্ভ থেকে। গোলরক্ষক ইয়ান সোমার ও রক্ষণের ফুটবলারেরা নিজেদের মধ্যে খেলে আক্রমণে ওঠেন। সেটাই আটকে দিলেন এনরিকে।

    প্রথম মিনিট থেকে পিএসজি-র প্রেসিং ফুটবল শুরু হল। বল পায়ে থাকলে নিজেদের মধ্যে দেওয়া-নেওয়া করে আক্রমণে উঠলেন , প্রতিপক্ষ ফুটবলারের দিকে তেড়ে ডিজ়ায়ার ডুয়ে, কাভারাত্‌স্কেলিয়ারা। আর বল পায়ে না থাকলে প্রতিপক্ষ ফুটবলারদের তাড়া করে গেলেন তাঁরা। মাঝেমধ্যেই সোমারের মতো গোলরক্ষক বল বার করতে সমস্যায় পড়ছিলেন। চাপে পড়ে ভুল করল ইন্টারের রক্ষণ। সেখান থেকেই এল প্রথম গোল। ১২ মিনিটের মাথায় ভিটিনহা ও ডুয়ে নিজেদের মধ্যে খেলে বক্সে অরক্ষিত হাকিমিকে পাস দিলেন। সেখান থেকে গোল মিস্‌ করা কঠিন ছিল। ফাঁকা গোলে বল ঠেলেও বাড়তি উল্লাস করতে দেখা গেল না মরক্কোর ফুটবলারকে। ইন্টার তাঁর পুরনো ক্লাব। তাই তাঁদের সমর্থকদের দিকে হাত দেখিয়ে বোধহয় ক্ষমাই চেয়ে নিলেন তিনি।

    সেই ধাক্কা কাটতে না কাটতে আবার গোল খেল ইন্টার। এ বার প্রতিআক্রমণ থেকে। বল ছিল পিএসজি-র বক্সে। সেখান থেকে লম্বা পাসে বল পেলেন দেম্বেলে। তিনি বল নিয়ে সোজা দৌড়ে গেলেন ইন্টারের বক্সে। তাঁর সামনে তখন চার জন ডিফেন্ডার। দেম্বেলে মাথা তুলে দেখলেন বক্সের অপর প্রান্তে অরক্ষিত দাঁড়িয়ে ডুয়ে। তাঁকে বল দিলেন দেম্বেলে। ডান পায়ের শটে গোল করলেন ডুয়ে। বল ইন্টার ডিফেন্ডার ডি’মার্কোর পায়ে লাগায় বল ধরতে সমস্যা হল সোমারের।

    গোটা প্রথমার্ধ জুড়ে এক বারও পিএসজি-র গোল লক্ষ্য করে শট মারতে পারেনি ইন্টার। বলের দখল পিএসজি-র কাছে ছিল ৬৩ শতাংশ। প্রেসিং ফুটবলে ইন্টারের সব পরিকল্পনা নষ্ট করে দিয়েছিল তারা। তার মাঝেই দুটো কর্নার থেকে সুযোগ পায় ইন্টার। আকেরবি ও থুরামের হেড গোলে ছিল না। অথচ বার্সার বিরুদ্ধে এই সেট পিস কাজে লাগিয়েই জিতেছিল ইন্টার। এই ম্যাচে তা হল না।

    দ্বিতীয়ার্ধেও খেলার ছবি বদলাল না। ইন্টার সামান্য বেশি আক্রমণ করল ঠিকই কিন্তু প্যারিসের ক্লাবের রক্ষণ ভাঙতে পারল না। উল্টে পিএসজি দ্বিতীয়ার্ধেও সেই একই কাজ করে গেল। প্রেসিং ফুটবল। আধুনিক ফুটবলে যে তার কোনও বিকল্প নেই তা প্রমাণ করে দিলেন এনরিকে। ৬২ মিনিটে নিজের দ্বিতীয় ও দলের তৃতীয় গোল করলেন ডুয়ে। পিএসজি-র ফুটবলারদের গতির কাছেও পেরে উঠল না ইন্টার। এ বারও গোলের আক্রমণ শুরু হল দেম্বেলের পায়ে। তিনি ব্যাকহিলে বল দিলেন ভিটিনহাকে। তাঁর কাছ থেকে বল পেয়ে বক্সে ঢুকে সোমারের বাঁ দিক দিয়ে বল জালে জড়িয়ে খেলার ফয়সালা করে দিলেন ডুয়ে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসাবে জোড়া গোল করলেন ১৯ বছর ৩৬২ দিনের ডুয়ে।

    বাকি সময়ে ইন্টারকে নিয়ে ছেলেখেলা করল পিএসজি। দেখে মনে হচ্ছিল প্রতিটা আক্রমণ থেকে গোল করবে তারা। ৩-০ গোলে এগিয়ে থাকার পরেও রক্ষণের ঝাঁজ কমায়নি তারা। ৭৩ মিনিটে দেম্বেলের থেকে বল পেয়ে বাঁ প্রান্ত ধরে দৌড়ে গেলেন কাভারাত্‌স্কেলিয়া। তাঁকে আটকাতে পারলেন না কোনও ডিফেন্ডার। সোমারকে পরাস্ত করে গোল করে তবে থামলেন তিনি। ৮১ মিনিটের মাথায় দলের পঞ্চম গোল করার সুযোগ পেয়েছিলেন বার্কোলা। একক দক্ষতায় ডিফেন্ডারদের টপকে যান তিনি। গোলরক্ষককে একা পেয়েও বাইরে মারেন তিনি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য পাঁচ নম্বর গোল এল। ৮৬ মিনিটে সেনি মায়ুলু ইন্টারের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতলেন। পাঁচ বছর আগের ফরাসি সমর্থকদের হতাশার কান্না বদলে গেল আনন্দাশ্রুতে।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)