রাজ্যে তাঁর আসার আগের দিনই প্রধানমন্ত্রীকে ‘মরসুমি, পরিযায়ী পাখি’ বলে কটাক্ষ করে প্রস্তুতি বুঝিয়ে দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। আর নরেন্দ্র মোদীর সফরের দিন বৃহস্পতিবার, সেই মেজাজ সপ্তমে চড়ালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রধানমন্ত্রী তথা ব্যক্তি মোদীকে আক্রমণ করেই মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রীর চ্যালেঞ্জ, ‘‘ক্ষমতা থাকলে কালই ভোট করুন! বাংলা বিজেপির হাতে যাবে না।’’
বিধানসভা ভোটের বছরখানেক আগে সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এ দিন রাজ্য বিজেপির নেতা-কর্মীদের কোমর বাঁধার বার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তার পরেই পাল্টা তৃণমূলের নির্বাচনী প্রস্তুতির বার্তা দিয়েছেন মমতাও। নবান্নে বসে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘‘নির্বাচনের সময় ভুল বোঝাতে, মিথ্যা ছড়াতে, চক্রান্ত করতে বাংলায় আসেন। ক্ষমতা থাকলে কালই নির্বাচন করুন! আমরা তৈরি আছি!’’ সেই সূত্রেই মমতার গলায় ভোটের হুঙ্কার— ‘‘বাংলার সংস্কৃতি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, নেতাজির পথে চলে। বাংলা বিজেপির হাতে যাবে না।’’
প্রধানমন্ত্রীর এ বারের দলীয় সভার সময় নিয়ে প্রশ্ন তুলে তৃণমূল নেত্রী বলেছেন, ‘‘বিরোধীরা (সংসদীয় প্রতিনিধিদলে) যখন দেশের হয়ে বিদেশে গলা ফাটাচ্ছেন, সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচারে রাজনীতির হোলি খেলতে এসেছেন!’’ মমতার আরও কটাক্ষ, ‘‘এক সময়ে চা-ওয়ালা বলে ঘুরে বেড়াতেন। দ্বিতীয় বার বললেন, পাহারাদার। এখন বলছেন, সিঁদুর বেচবেন! সিঁদুর এ ভাবে বেচা যায় না!’’ মোদীকে ‘ছুপা রুস্তম’ বলেও আক্রমণ শোনা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর গলায়।
গত বছর লোকসভা নির্বাচনের পরে এ দিনই দলীয় কর্মসূচিতে প্রথম বার রাজ্যে পা রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী। আলিপুরদুয়ারে বিজেপির সেই সভামঞ্চ থেকেই দুর্নীতি, আইশৃঙ্খলার অবনতি, বেকারি এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার নানা অভিযোগ করে মমতার সরকারের সমালোচনা করেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শেষ হওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই সে সবের জবাব নিজেই দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্য সরকারের সচিবালয় নবান্ন থেকে মমতা বলেছেন, ‘‘এখানে কোটি কোটি মানুষ। দু’একটা ঘটনা হলে আমরা পদক্ষেপ করি। মধ্যপ্রদেশে ‘ব্যপম’ কেলেঙ্কারিতে কী হয়েছিল! গুজরাতে সরকারি কর্মী পাকিস্তানের হয়ে কী ভাবে কাজ করছিল?’’ রাজ্যে নারী সুরক্ষা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর তীক্ষ্ণ সমালোচনা ফিরিয়ে দিয়ে মমতার বক্তব্য, ‘‘এক- আধটা ঘটনা ঘটলেও দু’তিন মাসের মধ্যেই আমরা ব্যবস্থা নিই। আপনারা তো নির্যাতনকারীকে বিজয়ী বানিয়ে ঘোরেন।’’
এই তরজার কেন্দ্রে ছিল ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সম্পর্কও। সেই সূত্রেই পারস্পরিক আক্রমণ এগিয়েছে নানা বিষয়ে। সাম্প্রদায়িক হিংসার জেরে রাজ্যে সম্প্রতি যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তৃণমূল সরকারকে বিঁধতে জনসভায় সেই মালদহ ও মুর্শিদাবাদের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। জবাবে সেই দায় বিজেপির দিকে ঠেলেই মমতা বলেছেন, ‘‘ওখানে চক্রান্ত হয়েছিল। সব তথ্য- প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। চাইলেই দিতে পারি।’’ রাজ্যের বেকারি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগে আমল না-দিয়ে মমতার দাবি, ‘‘রাজ্যে আমরা ৪০% বেকারি কমিয়েছি। বেড়েছে তো আপনাদের ওখানে।’’ প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ খারিজ করে আবাস ও কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পে রাজ্যের বকেয়া প্রাপ্যের কথাও উল্লেখ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, রাজ্যের শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো সব ব্যবস্থা ভাঙতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় সরকার। এ সব নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে মুখোমুখি বিতর্কেও আহ্বান জানিয়েছেন মমতা।
মোদীর বিরুদ্ধে সরাসরি ভোটের রাজনীতির অভিযোগ তুলে মমতা এ দিন বলেন, ‘‘ভেবেছিলাম, (প্রধানমন্ত্রী) সেনাবাহিনীর প্রতি সম্মান জানাতে আসছেন। কিন্তু তিনি তো তা করলেন না!’’ মমতার কথায়, ‘‘প্রচার তো হওয়ার কথা ছিল সেনাবাহিনীর। নিজের প্রচার করছেন! সেনাই দেশের অ্যাসেট, আপনি নন। আপনি ক্যাসেট!’’
রাজ্যে ভোটের বছরখানেক আগে থেকে মোদী-মমতার তরজা শুরু নিয়ে সরব হয়েছে বাম ও কংগ্রেসও। সেনাবাহিনীর কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী নিজেই নেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ করে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘কাশ্মীরে ভোট নেই। তাই মোদী সেখানে যাওয়ার সময় পাননি! গুজরাট, বিহার, বাংলায় ভোট আসছে, তিনিও আসছেন! আর ভোট সামনে বলেই মোদী ও দিদি নিজেদের মধ্যে লড়াই তৈরি করে নিযে ফের ভাগাভাগির খেলা শুরু করছেন।’’ একই সুরে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীও বলেছেন, ‘‘এত দিন মোদী বলতেন ‘বিকশিত ভারতে’র কথা। এখন ‘বিকশিত বাংলা’ শুরু হল, কারণ বোঝাই যাচ্ছে, ভোট আসছে। গত নির্বাচনে হেলিকপ্টার যুদ্ধ দেখেছে বাংলা। এ বার প্রধানমন্ত্রীর আক্রমণ এবং মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি আক্রমণ দেখে মনে হচ্ছে, ভোট যত কাছে আসবে, অসভ্যতার তত নজির তৈরি হবে!’’