• SSC মামলা: ‘অযোগ্যদের’ হয়েও কোর্টে লড়বে রাজ্য
    এই সময় | ২৯ মে ২০২৫
  • সুপ্রিম-রায়ে ‘অযোগ্য’ বা ‘টেন্টেড’ বলে চিহ্নিত শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের আশ্বাস দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবারই বলেছিলেন, তাঁরা যাতে অন্য দপ্তরে নিয়োগের সুযোগ পান, সেই বিষয়টা রাজ্য সরকার দেখছে। এই শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদের বেতনের টাকা ফেরতেরও নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট, যা সুপ্রিম কোর্টেও অপরিবর্তিত রয়েছে।

    কিন্তু সুপ্রিম–রায়ের পরে ৫৫ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনও তথাকথিত ‘টেন্টেড’ প্রার্থীরা কেউ টাকা ফেরত দেননি। রাজ্য সরকারও সেই টাকা আদায়ে এখনও কোনও পদক্ষেপ করেনি। সুপ্রিম–রায়ে চাকরিহারা প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীর হয়ে ইতিমধ্যে রাজ্য সরকার রিভিউ পিটিশন করেছে সর্বোচ্চ আদালতে।

    সেই আবেদনে কী বলা হয়েছে, তা সরকারের তরফে এখনও বিস্তারিত জানানো হয়নি। তবে বিকাশ ভবন সূত্রে জানা গিয়েছে, এই রিভিউ পিটিশনের শুনানিতে যাঁরা নিশ্চিত ভাবে ‘অযোগ্য’ বলে চিহ্নিত হননি (এর প্রেক্ষিতে যে শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীরা নিজেদের ‘যোগ্য’ বলে দাবি করছেন), তাঁদের পাশাপাশি ‘টেন্টেড’ বা ‘অযোগ্য বলে চিহ্নিত’দের হয়েও জোরদার সওয়াল করতে চলেছে রাজ্য।

    এই ‘অযোগ্য’ শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদের যাতে টাকা ফেরত দিতে না–হয়, সেই পয়েন্টেই রাজ্য তার যুক্তি সাজাচ্ছে বলে সূত্রের দাবি।

    কোন যুক্তিতে সওয়াল করতে পারে রাজ্য?

    সূত্রের খবর, এই ‘অযোগ্য’ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের হয়ে রাজ্য সরকার বলতে পারে, এঁরা অন্তত পাঁচ বছর ধরে কাজ করেছেন এবং তার বিনিময়ে বেতন পেয়েছেন। এখন তাঁদের বেতনের টাকা ফেরত দিতে বলার অর্থ, তাঁদের দিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করিয়ে নেওয়া। যা দেশের সংবিধানের পরিপন্থী।

    কাজের বিনিময়ে পাওয়া টাকা এত বছর বাদে ফেরত দিতে বললে তা ‘অন্যায্য’ এবং ‘অবিচার’ করা হবে বলেও আদালতের সামনে তুলে ধরতে চায় রাজ্য। তাদের আরও যুক্তি, সেই বেতনের টাকা ইতিমধ্যেই খরচ হয়ে গিয়েছে জীবন নির্বাহ করতে গিয়ে।

    ফলে আদা‍লতের কাছে যুক্তি তুলে ধরা হতে পারে, এতগুলো টাকা এখন তাঁরা পাবেন কোথা থেকে? ফলে এ ক্ষেত্রে আদালতের কাছে রাজ্যের আর্জি থাকবে, ভারতীয় সংবিধানের ১৪২ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যেন এ ক্ষেত্রে আদালত ‘কমপ্লিট জাস্টিস’ (ন্যায়বিচার দেওয়ার) ক্ষমতা ব্যবহার করে এই মানুষগুলোকে মুক্ত করে। রাজ্যের এই সম্ভাব্য আইনি যুক্তির সঙ্গে মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যকে সাযুজ্যপূর্ণ বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।

    যদিও বিকাশ ভবনের আধিকারিকদের একাংশের আশঙ্কা, ‘অযোগ্য’দের বেতন ফেরতের বিষয়টি এ ভাবে পিটিশনের মধ্যে রাখা হলে আদতে গোটা রিভিউ প্রক্রিয়াই না নাকচ হয়ে যায়। কারণ, সুপ্রিম রায়ে যাঁরা চিহ্নিত ‘টেন্টেড’ বা ‘অযোগ্য’, তাঁদের তরফে সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক আর্জি (র‍্যাঙ্ক জাম্প ও ওএমআর মিসম্যাচ) খারিজ করে দিয়েছে আদালত।

    এই আধিকারিকদের বক্তব্য, তাঁরা তাঁদের যুক্তি রাজ্য সরকারের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, যাতে শুনানির সময়ে সরকার ‘অযোগ্য’দের নিয়ে তাদের অবস্থান পরিমার্জন করে। এই ব্যাপারে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা হলেও তাঁর প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

    এসএসসি বা মধ্যশিক্ষা পর্ষদের আধিকারিকরাও কেউ মুখ খুলতে চাননি। তবে প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষা দপ্তরের এক কর্তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য, ‘আপনি তো বিষয়টা জানেন, আমার মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।’

    চাকরিহারা ‘যোগ্য’ শিক্ষকদের আন্দোলনের নেতা বৃন্দাবন ঘোষের বক্তব্য, ‘এই সরকার প্রথম থেকেই যোগ্য–অযোগ্য গুলিয়ে দিতে চেয়েছে। সেই কারণে এমন রিভিউ পিটিশনের পাশাপাশি যোগ্যদের রাস্তায় বসিয়ে অযোগ্যদের চাকরিও সরকার নিশ্চিত করতে চাইছে।

    আমাদের প্রশ্ন, এই ভাবে পিটিশনে গেলে তা আদৌ সুপ্রিম কোর্টে গ্রহণযোগ্য হবে কি না।’ দু’দিন আগে শিক্ষাসচিব ও অন্য কর্তারা যে দিন তাঁদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন, সে দিন কি তাঁরা এই বিষয়টা বলেছেন? বৃন্দাবন জানান, এই বিষয়টি নিয়ে সে দিন আলোচনা হয়নি।

    তথাকথিত ‘টেন্টেড’ বা ‘অযোগ্য’ শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদের অবশ্য দাবি, পাঁচ বছরের বেতন ফেরত দেওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য তাঁদের থাকলে, এই চাকরিটাও তাঁরা করতেন না। বেতন বাবদ যা আয় হয়েছিল, তার বেশির ভাগই খরচ হয়ে গিয়েছে। এত লক্ষ লক্ষ টাকা তাঁদের পক্ষে ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়। এবং টাকা ফেরতের নির্দেশ শুধু অন্যায্য নয়, অমানবিকও।

    আইনজীবী ও রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্র মনে করেন, রাজ্য সরকার যদি এই ভাবে সওয়াল করে, তা হলে তার পিছনে একটাই যুক্তি থাকতে পারে। সেটাকে অবশ্য আইনের চৌহদ্দির মধ্যে না দেখে মানবিকতার দিক থেকে দেখা যেতে পারে।

    জয়ন্তর কথায়, ‘এ কথা ঠিক তাঁরা এত বছর ধরে কাজ করেছেন। সেই কাজের গুণগত মান যাই হোক না কেন, সেই শ্রমের বিনিময়ে তাঁরা বেতন পেয়েছেন। সেই টাকা এখন ফেরত দেওয়ার মতো সামর্থ্য প্রায় কারওরই থাকার কথা নয়।’

    কিন্তু রাজ্যের অবস্থান নিয়ে সন্দিহান জয়ন্তর প্রশ্ন, ‘অযোগ্যদের ঢাল করে রাজ্য আসলে সেই দুর্নীতিগ্রস্তদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে না তো, যারা এই অযোগ্যদের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য টাকা তুলেছিল?’

    বিরোধীদের অনেক দিনেরই অভিযোগ, এসএসসি–র নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে এখনও অনেক অপরাধীই ধরা পড়েনি। চাকরি বিক্রির টাকা যারা ঘরে তুলেছিল, তাদের সকলকে এখনও চিহ্নিত করা যায়নি। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘একজন চোর যদি গিয়ে বলে আমার চুরি করতে অনেক শ্রম লেগেছে, তা বলে কি তাকে রেহাই করে দেওয়া যায়? এই যুক্তি আইনত এবং নীতিগত ভাবেও ঠিক নয়।’

    ‘অযোগ্য’দের প্রসঙ্গ থাকলেও, পিটিশনের বড় অংশ জুড়ে অবশ্য থাকছে ‘যোগ্য’দের চাকরি ফেরতেরও প্রসঙ্গ। সূত্রের খবর, রাজ্য আদালতে যুক্তি দিতে পারে, এসএসসির ‘তথাকথিত’ অনিয়মের জন্য কেন এতগুলো নির্দোষ মানুষকে এই সমস্যার মধ্যে পড়তে হবে, কেন তাঁদের জীবন–জীবিকা নির্বাহ করার অধিকার চলে যাবে, যখন তাঁরা কোনও দোষই করেননি?

    সুপ্রিম–রায়ে উল্লেখ, মোট ‘টেন্টেড’ বা ‘অযোগ্যে’র সংখ্যা ৬,২৭৬ জন। কিন্তু রাজ্যের দাবি, সংখ্যাটা আরও কম। রাজ্যের হিসেব অনুযায়ী, ৫,৩০৩–এর বেশি আর কোনও ‘অযোগ্য’ এই চাকরি খোয়ানো ২৬ হাজার শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীর মধ্যে নেই। একই সঙ্গে স্কুলের পরিকাঠামো ভেঙে পড়ার যুক্তিও তোলা হবে।

    এ ক্ষেত্রে রাজ্যের হাতিয়ার নিট কেলেঙ্কারি। যেখানে ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষায় দুর্নীতি ও প্রশ্ন ফাঁস ধরা পড়ার পরেও সুপ্রিম কোর্ট ছাত্রছাত্রীদের কথা মাথায় রেখে পুরো পরীক্ষা বাতিল করেনি, সেখানে এত শিক্ষকের একলপ্তে চাকরি চলে গেলে বাংলার ৭৮ লক্ষ পড়ুয়ার ভবিষ্যৎ, পড়াশোনা কী ভাবে চলবে তা কেন মাথায় রাখা হচ্ছে না— এই প্রশ্নটাও তোলা হচ্ছে আদালতের কাছে।

    যদিও ‘বঞ্চিত’ চাকরিপ্রার্থীদের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের দাবি, ‘কোনও রিভিউ পিটিশনই ধোপে টিকবে না। কারণ, ইতিমধ্যে রাজ্য সরকার নতুন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে বলে জানিয়েছে। আদালতেও তারা সেই কথাই বলে এসেছে।’

    মুখ্যমন্ত্রী মঙ্গলবার জানিয়েছিলেন, ‘যোগ্য’ শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীরা নিয়োগ পরীক্ষায় বসলে তাঁদের পূর্ব অভিজ্ঞতার সাপেক্ষে তাঁদের বাড়তি নম্বর দেওয়া হতে পারে। যদিও আইনজ্ঞদের অনেকে বলছেন, সে ক্ষেত্রেও বড় আইনি সমস্যা হতে পারে।

    তাঁদের ব্যাখ্যা, সুপ্রিম কোর্ট মধ্যশিক্ষা পর্ষদের মডিফিকেশন অ্যাপ্লিকেশন বিবেচনার সময়েই জানিয়ে দিয়েছিল, এই ‘যোগ্য’ শিক্ষকদের নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোনও বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। ফলে রাজ্য তাঁদের জন্য কোনও বিশেষ সুবিধা দিতে গেলে তা সুপ্রিম–রায়ের পরিপন্থী হবে।

  • Link to this news (এই সময়)