• কেস চলবে, পরীক্ষাও, হতাশ চাকরিহারারা
    এই সময় | ২৮ মে ২০২৫
  • এই সময়: এসএসসি মামলায় সুপ্রিম-রায়ের চার দিনের মাথায় গত ৭ এপ্রিল নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ‘যোগ্য’ চাকরিহারাদের সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, তাঁর কাছে প্ল্যান এ, বি, সি, ডি এবং ই আছে। তারপরেও সরকার তাঁদের জন্য ঠিক কী করছে, তার কোনও স্পষ্ট ধারণা ছিল না ‘যোগ্য’ চাকরিহারা শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদের কাছে।

    তাঁরা সল্টলেকে বিকাশ ভবন ও এসএসসি দপ্তরের সামনে লাগাতার বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, পুলিশের লাঠি খেয়েছেন, এখনও ধর্নায় বসে রয়েছেন তাঁদের অনেকে। এই প্রেক্ষাপটে নেতাজি ইন্ডোরের সভার ৪৯ দিন বাদে, মঙ্গলবার নবান্ন থেকে জরুরি সাংবাদিক বৈঠক করলেন মুখ্যমন্ত্রী।

    একাধারে সুপ্রিম-রায়কে মান্যতা দেওয়া এবং অন্যদিকে ‘যোগ্য’ চাকরিহারাদের ক্ষোভে ভারসাম্য রাখতে দু’টি অপশন দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর স্পষ্ট বার্তা— রাজ্য সরকার সাংবিধানিক ভাবে সুপ্রিম–রায় অমান্য করতে পারে না। সেটা মাথায় রেখেই অপশন এ ও বি ভাবা হয়েছে।

    প্রথম অপশন— সুপ্রিম–নির্দেশ মেনে ৩১ মের মধ্যে নতুন করে বিজ্ঞপ্তি জারি করবে রাজ্য। তাতে ‘যোগ্য’ শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদেরও বসতে হবে। পরে যাতে সুপ্রিম কোর্ট বলতে না-পারে, যে তাদের নির্দেশ মানা হয়নি। এই প্রার্থীদের জন্য বয়সের ছাড়ের পাশাপাশি এতদিন স্কুলে পড়ানোর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কিছু বাড়তি নম্বর দেওয়া হতে পারে।

    দ্বিতীয় অপশন, রিভিউতে ভালো ফল পেলে (অর্থাৎ, ‘যোগ্য’ চাকরিহারাদের কোনও পরীক্ষা ছাড়াই চাকরি বহাল রাখা) সেটা রাজ্য গ্রহণ করবে। এই অবস্থায় মঙ্গলবার ৪৪ হাজার ২০৩টি পদে এসএসসি–র শিক্ষক–শিক্ষাকর্মী নিয়োগের কথা ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই সঙ্গে চাকরিহারাদের দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে তাঁদের জানালেন, বাকি বিষয়টা রিভিউ পিটিশনের উপরেই নির্ভর করছে।

    যাঁরা এতদিন ধরে আন্দোলন চালাচ্ছেন, সেই ‘যোগ্য’ শিক্ষক–শিক্ষিকাদের কি আশ্বস্ত করতে পারল এই রায়? সামগ্রিক ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় হতাশ তাঁরা। সল্টলেকে আন্দোলনরত ‘যোগ্য শিক্ষক–শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চে’র বৃন্দাবন ঘোষ বলেন, ‘সাত বছর পরে আমাদের আবার পরীক্ষা দিতে হবে। আমরা কেউ পরীক্ষা দিতে চাইনি। মুখ্যমন্ত্রী আমাদের মৃত্যু পরোয়ানাই তো লিখে দিলেন।’

    সাংবাদিক বৈঠকে মমতা জানান, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনেই ৩১ মে-র মধ্যে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করবে স্কুল সার্ভিস কমিশন। পাশাপাশি আইনি লড়াইও চলবে। তাঁর কথায়, ‘সঠিক সময়ে সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ পিটিশন জমা দিয়েছে রাজ্য সরকার। এখন গরমের ছুটি থাকার কারণে আদালত বন্ধ। তাই আদালত খুললে আবার আইনি প্রক্রিয়া শুরু হবে। তবে সুপ্রিম কোর্ট যাতে বলতে না–পারে যে, নির্দেশ মানা হয়নি, তাই ৩০ মে-র মধ্যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে।’

    মমতা জানিয়েছেন, শীর্ষ আদালতের এই নির্দেশ না-মানলে তার ফল চাকরিহারা শিক্ষকদেরই ভুগতে হতে পারে। তাঁর সংযোজন, ‘সরকার কারও চাকরি কেড়ে নেওয়ার পক্ষপাতী নয়। চাকরিপ্রার্থীদের স্বার্থেই রাজ্য বিজ্ঞপ্তি জারি করতে চলেছে।’

    এই কারণে হাইকোর্ট নির্ধারিত ডিমড (পূর্ব শূন্যপদ) ২৪ হাজার ২০৩ শূন্যপদের পাশাপাশি অতিরিক্ত ২০ হাজার পদও তৈরি করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে চারটি ক্যাটিগরিতে মোট ৪৪ হাজার ২০৩ পদে নিয়োগ পরীক্ষা নেবে কমিশন। যে চাকরিহারারা নিয়োগ পরীক্ষায় বসার বয়স পেরিয়ে গিয়েছেন, তাঁদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।

    তাঁদের বয়সের সীমায় ছাড় দেওয়া হবে। এই ‘যোগ্য’ চাকরিহারাদের বিজ্ঞপ্তি দেখে নতুন নিয়োগে আবেদন করার কথাও বলেছেন তিনি। রিভিউ পিটিশনের নির্দেশ তাঁদের পক্ষে না-গেলেও যাতে চাকরি পাওয়ার সুযোগ থাকে, সেই জন্যই এই বার্তা।

    চাকরিহারাদের উদ্দেশে মমতা বলেন, ‘রিভিউ পিটিশনে সরকারি আইনজীবীরা সাধ্যমতো লড়াইয়ের চেষ্টা করবেন। আপনারা ভয় পাচ্ছেন কেন! কোর্টকে জানাতে হবে। আমরা বিজ্ঞপ্তি জারির আগে সংবাদমাধ্যমেও জানিয়েছি। আমরা আপনাদের পাশে ছিলাম, আছি, থাকব। যোগ্যতা রয়েছে যাঁদের, সকলেই আবেদন করতে পারবেন (নতুন নিয়োগ পরীক্ষায়)। বাদবাকি সবকিছু আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।’

    মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘রিভিউয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বললে হবে না, পরীক্ষা দেবো না। তা হলে চাকরিই থাকবে না। এটা আমাদের নির্দেশ নয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ। সরকার কোর্টে গিয়ে আপনাদের চাকরি বাতিল করেনি। কিছু স্বার্থপর মানুষ বাতিল করেছেন। নিজেদের স্বার্থে করেছেন। আজ তাঁরা বন্ধু হয়ে ঢোকার চেষ্টা করছেন।

    সকলকে বলব, সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুযায়ী, অপশন এক ও দুই কাজে লাগান। আপনারা পরীক্ষা দিলেন না, এ দিকে রিভিউ পিটিশন করে বিচার না-পেলে, আপনাদের চাকরি ফিরে পাওয়ার সুযোগও থাকবে না। শীর্ষ আদালত কবে খুলবে জানি না। গরমের ছুটি শেষ হলেই রিভিউ পিটিশন নিয়ে আবার তৎপর হব।’

    তাঁর সংযোজন, ‘বিচার আমার হাতে নেই। বিচারের দায়িত্ব বিচারপতিদের হাতে। মানবিক ভাবে তুলে ধরব, যাতে চাকরি বাতিল না হয়।’ মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা যাঁরা সরকার চালাই, আমাদের আইন মেনে চলতে হয়। আইনের বাইরে গিয়ে যদি কিছু করি, অন্য বার্তা যেতে পারে। সঠিক সময়ে রিভিউ পিটিশন দিয়েছি। সেখানে কারও চাকরি যাওয়ার কথাও বলিনি। রিভিউ নিয়ে আলোচনার সুযোগ আসেনি। আমরা ততক্ষণ অপেক্ষা করলে এবং আগের অর্ডার না-মানলে, যদি সুপ্রিম কোর্ট বলে, নির্দেশ মানেনি...সবটাই বাতিল, এটা আমরা চাই না।’

    একইসঙ্গে ‘যোগ্য’ শিক্ষকদের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘পরীক্ষায় বসুন। স্কুলে যাচ্ছেন, যান। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাইনেও পাবেন। সুযোগ আসবে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করুন। কোর্টের নির্দেশ আমি না-মানলে ২৬ হাজার শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীই বিপদে পড়তে পারেন। তাই দুটো পথই খোলা রাখা হয়েছে।’

    মমতার দাবি, ‘টেন্টেড’ বা ‘অযোগ্য বলে চিহ্নিত’ যাঁদের টাকা ফেরত দিতে বলা হয়েছে, চাকরি বাতিল করা হয়েছে, এবং বলা হয়েছে এসএসসি-র নতুন পরীক্ষায় বসতে পারবেন না, তাঁরা অন্য সরকারি দপ্তরে যোগ দিতেই পারেন। কোর্ট সে কথা বলেছে (যদিও সুপ্রিম–রায়ে তার উল্লেখ নেই)।

    শিক্ষা বিভাগেও লোক প্রয়োজন। ঘর পরিষ্কার, ঘণ্টা বাজানোর লোক নেই (যদিও শিক্ষা দপ্তরে ঘণ্টা বাজানোর দরকার কেন‍, তার ব্যাখ্যা মুখ্যমন্ত্রী দেননি), তালাবন্ধ করার লোক নেই। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘যেমন অতিরিক্ত গ্রুপ সি এবং ডি নিচ্ছি। অনেকে শিক্ষা বিভাগে কাজ করছেন, অথচ চাকরি বাতিল হয়েছে, তাঁরাও শিক্ষা বিভাগে আবেদন করতে পারেন। আরও তিন–চারটি বিভাগে আবেদনের সুযোগ দেবো। তবে আলাদা ভাবে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে। এর সঙ্গে ওটার সম্পর্ক নেই।’

    মমতা বারবার বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে আমরা সবটাই রেডি করে রাখছি। যদি রিভিউয়ে আদালত বলে, পরীক্ষা দিতে হবে না (‘যোগ্য’দের), লিস্ট (প্যানেল) বাতিল করা হলো না, তখন সুপ্রিম কোর্টের কথাই শুনব। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনেই বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হবে।

    আমরা চাই, যে চাকরিহারারা সকলে চাকরি ফিরে পান। অনেকে একক ভাবেও কোর্টে গিয়েছেন। কোর্ট থেকে নেগেটিভ রিপোর্ট আসছে (র‍্যাঙ্ক জাম্প ও ওএমআর মিসম্যাচ প্রার্থীদের মামলা)। এটা যে কেউ যেতে পারেন। এটা তাঁদের অধিকার। সরকারকে সবারটা নিয়েই মামলা করতে হয়। রাজ্য করলে সকলের স্বার্থ দেখতে হয়।’

  • Link to this news (এই সময়)