প্রদীপ চক্রবর্তী, চুঁচুড়া
গঙ্গার ঘাট কি ক্রমেই ‘মৃত্যু ফাঁদ’ হয়ে উঠছে। গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে অনেকেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ছেন। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। কখনও ঘাটে পা পিছলে গিয়ে নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে কিশোর। কখনও আবার গঙ্গায় প্রতিমা বিসর্জন দিতে গিয়ে জলে ডুবে মৃত্যু হচ্ছে।
সবথেকে উদ্বেগের বিষয় হলো, মৃতদের অধিকাংশই নাবালক। যাদের অনেকেই সাঁতার জানে না। এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন প্রশাসন। কী ভাবে এই দুর্ঘটনা ঠেকানো যায়, তা নিয়ে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়েছে। গঙ্গার ঘাটে নজরদারি বাড়ানোর জন্য পাকাপাকি ভাবে সিসিটিভি বসানো এবং প্রশিক্ষিত সিভিক পুলিশ এবং জলসাথী নিয়োগের কথাও ভাবা হচ্ছে।
পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছরে শেওড়াফুলি, শ্রীরামপুর, রিষড়া, কোন্নগর এবং উত্তরপাড়া ঘাটে মোট ১৫ জন জলে ডুবে মারা গিয়েছে। মৃতদের তালিকায় বেশিরভাগই স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া। পুলিশি তদন্তে স্পষ্ট হয়েছে, গঙ্গায় তলিয়ে গিয়ে যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের বেশিরভাগই সাঁতার জানত না। তবে সেটাই একমাত্র কারণ নয় বলে মনে করছে পুলিশ। এর পিছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। আর সেটাই বেশি করে ভাবাচ্ছে পুলিশকে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, হুগলি জেলার অধিকাংশ গঙ্গার ঘাটের অবস্থা অত্যন্ত বেহাল। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় ঘাটগুলি কার্যত মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে। নদীতে জল বেশি থাকলে ঘাটে কোথায় গর্ত হয়ে রয়েছে, সেটা বাইরে থেকে বোঝা যায় না।
ফলে ভুলবশত ইটের খাঁজে পা পড়লেই তাতে পা আটকে যাচ্ছে। পলি জমে নদীর মাঝখানটা উঁচু হয়ে যাওয়ায় পাড়ের দিকে চোরাস্রোত তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে যাঁরা সাঁতার জানেন না, তাঁরা চোরাস্রোতের টানে নদীতে তলিয়ে যাচ্ছেন। কোথাও আবার ঘাটের নীচে মাটি সরে গিয়ে গভীর খাদ তৈরি হয়েছে। ভুল করে সেখানে পা পড়লেই বিপদ ঘটছে।
অভিযোগ, হুগলির কয়েকটি ঘাটে জলসাথী প্রকল্পে কিছু কর্মী নিয়োগ করা হলেও বেশিরভাগ জায়গায় কোনও নজরদারি থাকে না। নেই কোনও সিসিটিভি। তার জেরেই গঙ্গার ঘাটে প্রাণহানির ঘটনা বাড়ছে। প্রশাসনিক কর্তারা অবশ্য এর জন্য মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করছেন।
জেলা পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, ‘এখন বাবা–মায়েরা সন্তানের লেখাপড়ার ব্যাপারে খুবই সচেতন। কিন্তু আত্মরক্ষার জন্য ছেলে–মেয়েদের সাঁতার শেখানোটা যে জরুরি, সেটা তাঁরা ভুলে যান। তাই শুধু নজরদারি বাড়ালে হবে না, এ ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।’
কোন্নগর পুরসভার স্বপন দাস বলেন, ‘দুর্ঘটনা ঠেকানোর জন্য বারো মন্দির ঘাটে এখন দড়ি ফেলা থাকে। দড়ির বদলে লোহার শিকল দিয়ে ফেন্সিং করার জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।’
উত্তরপাড়া পুরসভার পুরপ্রধান দিলীপ যাদব বলেন, ‘উত্তরপাড়া ফেরিঘাটে জলসাথী প্রকল্পের কর্মীরা নজরদারি চালান। এ ছাড়া ভেসেলে লাইফ জ্যাকেট ও অন্যান্য সরঞ্জাম রাখা হয়। ঘাটে সিসিটিভি রয়েছে।’
শ্রীরামপুর পুরসভার চেয়ারম্যান ইন কাউন্সিলের সদস্য সন্তোষ কুমার সিংহ বলেন, ‘আমাদের পুরসভা এলাকায় ৩২টি স্নানের ঘাট আছে। সাংসদ তহবিলের টাকায় বেশ কয়েকটি ঘাটের সংস্কার করা হয়েছে। দুটি ঘাটে জলসাথী প্রকল্পের কর্মীরা আছেন।’
শ্রীরামপুরের পুরপ্রধান গিরীধারী শাহ বলেন, ‘গঙ্গায় পলি জমে যাচ্ছে। ছিন্নমস্তা ঘাট বিপজ্জনক হয়ে আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ঘাট সংস্কারের আর্জি জানিয়েও কোনও কাজ হয়নি। রাজ্য সরকার গঙ্গার ঘাটের সংস্কারের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছে।’