কোনওটির নাম ‘কোমল জীবন’। কোনওটির নাম ‘পবিত্র নীর’! বোতলের গায়ে সাঁটা প্লাস্টিকের লেবেলে এই নামগুলিই এখন কলকাতার বহু এলাকার বাসিন্দাদের ভরসা। গরম পড়তেই জলকষ্টের যে চিত্র সামনে আসছে, তার জেরে এমন বোতলবন্দি জলই কিনে খেতে হচ্ছে তাঁদের। বাদ যাচ্ছেন না খোদ কলকাতা পুরসভার জল সরবরাহ বিভাগের পদস্থ জনৈক আধিকারিকও। বাঘা যতীন স্টেশনের কাছে ১০২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ওই আধিকারিক বললেন, ‘‘পরিস্রুত জল এখনও পাই না। টিউবওয়েলে জল এলেও তা লালচে রঙের। তাই বাধ্য হয়েই জল কিনে খেতে হয়।’’
কিন্তু কেনা এই জল কি আদৌ পরিস্রুত? প্রশ্ন রয়েছে তা নিয়েও। বিশেষজ্ঞ থেকে পরিবেশকর্মীদের বড় অংশের দাবি, কলকাতাবাসীর সামনে এখন উভয়-সঙ্কট। সরকারি পরিস্রুত জল মিলছে না। কেনা জলেও বিষ! কারণ, বহু জায়গাতেই সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে মাটির নীচ থেকে জল তুলে কোনও রকম পরিশোধন না করেই বোতলে ভরে বিক্রি করা হচ্ছে ‘মিনারেল ওয়াটার’ নামে! অভিযোগ, আর্সেনিক-যুক্ত জলও বোতলে ভরে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে সরাসরি।
জলের উপরে কর আদায়ে পুরসভার অনীহার কথা অজানা নয়। জল কর না নেওয়ার কারণ হিসাবে জনগণের উপরে খরচের বোঝা না চাপানোর যে যুক্তি দেখায় পুর প্রশাসন, সে ব্যাপারে তারা আদৌ কতটা চিন্তিত, প্রশ্ন রয়েছে তা নিয়েই। কারণ, পুরসভা সূত্রেই খবর, কলকাতায় এখনও এমন বহু ওয়ার্ড রয়েছে, যেখানে গরমে তো বটেই, শীতেও জল কিনে খেতে হয়। দক্ষিণ কলকাতার ১১১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা তন্ময় সাহা যেমন বলছিলেন, ‘‘পুরসভা জল কর চাপাতে চায় না। কিন্তু জল কিনে খেতে গিয়েও তো পকেট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে! পুরসভার যে গাড়ি আসে, সেটির সামনে এত লম্বা লাইন পড়ে যে, বহু সময়ে জল পাওয়াই যায় না। তাই বাধ্য হয়েই জল কিনে খাই।’’ ১১৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাঁশদ্রোণীর সোনালি পার্ক, পালপাড়া ও পূর্ব আনন্দপল্লির বাসিন্দাদের অনেকের আবার বক্তব্য, ‘‘জল কর নিলে পরিস্রুত জল দেওয়ার দায় থাকে। পুরসভা সেই দায় এড়াতেই এ পথে হাঁটছে।’’
১১১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রাক্তন বাম পুরপ্রতিনিধি চয়ন ভট্টাচার্যের আবার দাবি, ‘‘আমিও দিনকয়েক আগে পুরসভার এক গাড়ি জল কিনে বাড়ির জলাধারে ভরেছি। ৫৫০ টাকা পুরসভাকে দিতে হয়েছে। এর চেয়ে জল কর দিয়ে পরিস্রুত পানীয় জল পাওয়া ভাল।’’ সোনালি পার্কের এক বাসিন্দার আবার বক্তব্য, ‘‘পুরসভা যে জল দেয়, তা এতই খারাপ যে, ফিল্টারে ময়লা জমে তা অচল হয়ে যায়। এখানে এমনই অবস্থা, মিষ্টির বা মুদির দোকানেও জলের জেরিক্যান বিক্রি হয়।’’
দোকানে বিক্রি হওয়া বোতলবন্দি জল কি পরিস্রুত? নিয়ম বলছে, পানীয় জলের বোতলে ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি অব ইন্ডিয়া’র ছাপ থাকা বাধ্যতামূলক। বোতলবন্দি জলের প্রকল্প তৈরি করতেও অনুমতি নিতে হয়। কারখানার ভিতরে ল্যাবরেটরি রাখাও বাধ্যতামূলক। প্রকল্পস্থলের ঠিকানাও বোতলের গায়ে লিখে রাখার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু অভিযোগ, অধিকাংশ জলের ব্যবসাতেই কোনও নিয়ম মানা হয় না। কয়েক বছর আগে কলকাতা এবং শহরতলির বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে জলের এমন প্রচুর অবৈধ কারখানা বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ ও পুরসভা। কিন্তু তার পরেও পরিস্থিতির বদল হয়নি বলে অভিযোগ। ভূগর্ভের জলে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক রয়েছে, স্বাস্থ্য দফতরের চিহ্নিত করা এমন এলাকাতেও পাম্পের সাহায্যে মাটির নীচ থেকে জল তুলে বোতলে ভরে বিক্রি করা হচ্ছে। ওই সব কারখানার না আছে কোনও বৈধ নথি, না আছে ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি অব ইন্ডিয়া’র অনুমতি। মালিকদের যদিও পাল্টা যুক্তি, ‘‘সরকার যদি বিশুদ্ধ জল সরবরাহের ব্যবস্থা করতে পারত, তা হলে তো কেউ আমাদের জল কিনত না! এত কারখানা চলতও না।’’
বড়সড় অভিযোগ রয়েছে জলের দাম নিয়েও। নামী সংস্থার ২০ লিটারের জলের জার ৮০ টাকায় পাওয়া যায়। আবার সেই জলই এক লিটারের বোতলে ভরে বিক্রি করা হয় ২০ টাকায়। আবার সেই জলই বিমানবন্দর কিংবা মাল্টিপ্লেক্সে বিক্রি হয়, কোথাও ৫০, কোথাও ১০০ টাকা বা তারও বেশি দামে! দামের এই তারতম্যের কোনও স্পষ্ট যুক্তিও মেলে না কখনও। সংস্থাগুলি ইচ্ছেমতো দাম হাঁকে। অনামী সংস্থাগুলি কম দামে জল দিলেও কোনও পরীক্ষার ধার ধারে না। পরিসংখ্যান বলছে, চার-পাঁচ বছর আগেও বোতলবন্দি পানীয় জলের বাৎসরিক ব্যবসা ছিল পাঁচ হাজার কোটি টাকার। এখন তা ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। কথায় বলে, জলেই গেল টাকা। বোতলবন্দি জল কিনতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই তা ঘটছে না তো?