দিগন্ত মান্না, পাঁশকুড়া
বাড়ির বারান্দার এক কোণে রাখা লাল রংয়ের সাইকেলটায় টানা ন’দিন কেউ হাত দেয়নি। ১৮ মে ওই সাইকেলে চেপেই চিপস কিনতে গিয়েছিল ছেলেটা। তার পরের ঘটনা টানা ক’দিন শিরোনামে থেকেছে। এত কিছু বোঝে না মায়ের মন। তিনি শুধু জানেন, সবসময়ে হাসিখুশি থাকা ছেলেটা আর নেই। অথচ ওর বই-খাতা, সাইকেল, জুতো — সব রয়েছে নিজের জায়গায়।
আটপৌরে ভাড়া বাড়িটার তিন দিকে দরজা। ছোট্ট দু’টি ঘরে পাতা সংসার। যে সংসারে এখন শুধুই শূন্যতা। যে রুমে থাকত ছেলেটা, সেখানে এখনও ভাষাপাঠ, সাহিত্য বিচিত্রা, স্বাস্থ্য ও শারীরশিক্ষার বইগুলি রয়েছে। কিছু গুছিয়ে রাখা, কোনওটা খোলা।
দখিনা বাতাসে খাতার পাতাগুলো পতপত শব্দ করে। সেই শব্দে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে মায়ের। স্কুলে গরমের ছুটি পড়ার আগে প্রথম পার্বিক মূল্যায়নের খাতা বের হয়। বইয়ের সঙ্গে রয়েছে পরীক্ষার খাতাগুলোও। অঙ্কে ফুলমার্কস ৩০ পেয়েছে সে।
ইতিহাসে পেয়েছে ৩০-এর মধ্যে সাড়ে ২৮। বাংলায় ২৯। খাতা হাতে নিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন মা। কান্নার আওয়াজ শুনে ধীরে ধীরে ভয় কাটিয়ে মৃত ছাত্রের বাড়িতে ভিড় জমাতে শুরু করলেন প্রতিবেশী মহিলারা।
ছাত্রটির মৃত্যুর পরে অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার শুভঙ্কর দীক্ষিতের বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনায় এফআইআর দায়ের হতেই কার্যত পুরুষশূন্য গোটা গ্রাম। তবে রবিবার শুভঙ্করের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হতেই ধীরে ধীরে ভয় কাটিয়ে বাড়িতে ভিড় করছেন গ্রামের মহিলারা।
পড়শি এক মহিলা বলেন, ‘ছেলেটা সব গুণের অধিকারী ছিল। আত্মসম্মানবোধ একটু বেশিই ছিল। মনে হচ্ছে, যেন ঘরের ছেলেকেই হারালাম।’ আরও এক মহিলা বলেন, ‘সে দিন দেখলাম, ছেলেটার পিছনে মোটর বাইক নিয়ে ধাওয়া করছে সিভিক ভলান্টিয়ার শুভঙ্কর দীক্ষিত। এত ভালো একটা ছেলেকে অকালে শেষ করে দিল শুভঙ্কর।’
তবে অভিযোগ দায়ের হতেই খোঁজ নেই সিভিক ভলান্টিয়ারের। মামলার তদন্তকারী অফিসার সুকুমার টুডু জানিয়েছেন, শুভঙ্কর পলাতক। তদন্ত শুরু হয়েছে। অথচ রবিবার পাঁশকুড়া থানার আইসি দাবি করেছিলেন, ওই সিভিক ভলান্টিয়ার ডিউটি করছেন। পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়ে মৃত ছাত্রের মা বলেন, ‘পুলিশ অভিযুক্তকে আড়াল করতে চাইছে।’
তবে এ নিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন ধরেননি পাঁশকুড়া থানার আইসি সমর দে।অন্য দিকে, এই ঘটনায় প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে, আরও একটি নাম। শ্যামচরণ ভুঁইয়া নামে ওই ব্যক্তি এলাকায় জামাই বলেই পরিচিত। পাড়ার লোকেরা জানিয়েছেন, সে দিন ছাত্রটিকে বকা–ঝকা করে শুভঙ্কর চলে যেতেই ‘মাতব্বরি’ করতে এগিয়ে আসে সে।
বালকটিকে দাঁড় করিয়ে ‘চুরি করেছিস’ বলে বেশ খানিকটা বকা–ঝকা করে। শুভঙ্করের স্ত্রী নিশার দাবি, ওই ব্যক্তিই যেচে বালকের বাড়িতে গিয়ে তাকে চোর অপবাদ দেয়। সে–ই বালক ও তার মাকে দোকানে ডেকে আনে। এলাকাবাসীর মতে, আত্মহত্যার প্ররোচনায় হাত রয়েছে এই জামাইয়েরও।
তবে শুভঙ্করের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় দায়ের করা অভিযোগে নাম থাকায়, গ্রামের বাকি পুরুষদের মতো সে–ও ফেরার। তার স্ত্রী ছবি ভুঁইয়া বলেন, ‘লোকের মুখে শুনেছি, আমার স্বামী ছাত্রটির বাড়িতে চিপস চুরির ব্যাপারে জানিয়েছিল। এর বেশি কিছু জানি না। আমার স্বামী যাত্রাদলে রান্না করে। তিন দিন আগে কাজে চলে গিয়েছে।’
তবে এ সবে আর মন নেই পরিবারের। ভাইয়ের বই-খাতাগুলো গোছাতে গোছাতে মৃতের দিদি বলছিল, ‘আর কী হবে? সবই তো শেষ।’ মা বললেন, ‘ছেলেটা মেধাবী ছিল। ভেবেছিলাম বড় হয়ে ওকে আমার মতো দিনমজুরি করতে হবে না। এখন বলুন তো কী নিয়ে আমি বাঁচব!’