আর জি করের চিকিৎসক-পড়ুয়ার মৃত্যুতে দল-মত নির্বিশেষে আলোড়নের কথা বলছিলেন তৃণমূলের মুখপাত্র অরূপ চক্রবর্তী। ‘‘কিন্তু সেই ঘটনার সঙ্গে জড়ানো কিছু ভুয়ো খবর, অডিয়ো ক্লিপের প্রচার আন্দোলনটির সৎ আবেগকে সাহায্য করেনি! শর্ট কাটে আন্দোলন চলে না।’’ —বললেন তিনি। প্রতিপক্ষ-শিবিরে সিপিএমের শতরূপ ঘোষ বললেন, প্রথম ভুয়ো খবরটি কিন্তু তরুণী আত্মঘাতী হয়েছেন বলে হাসপাতালের তরফেই তাঁর মা-বাবাকে জানানো হয়! শনিবার ক্যালকাটা ডিবেটিং সার্কলের (সিডিএস) বিতর্ক-সভায় অল্পবিস্তর ফরাসি বিপ্লব, নভেম্বর বিপ্লব, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা উঠেছিল। কিন্তু বিতর্কে ‘আমাদের আন্দোলনে রাগ আছে, আবেগ আছে, উদ্দেশ্য নেই’ প্রস্তাবনাটি প্রধানত এ রাজ্যের আর জি কর-কাণ্ড ঘিরে আন্দোলনের বৃত্তেই ঘুরপাক খেল।
আনন্দবাজার পত্রিকা ও আরও আনন্দ অ্যাপের সহায়তায় ক্যালকাটা ক্লাব প্যাভিলিয়নের বিতর্ক-আসরে সঞ্চালক, চিকিৎসক কুণাল সরকার আর জি কর-পরবর্তী বাঙালির হৃদয় খুঁড়ে তার ন্যায়-সচেতনতা কত দূর বুঝতে বক্তাদের উস্কে দেন। দেখা গেল, দুই শিবিরই সেই আন্দোলনের সাফল্যের মাত্রা নিয়ে ধন্দে। সভার মতের বক্তা, রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী রাজনীতি বা ভোটফলের নিরিখে আন্দোলনের প্রভাব জরিপ করলেন। ওই পক্ষে বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের চেনা কণ্ঠ পৌলমী নাগ বলেন, ‘‘আশাবাদী হয়েও আমি বাস্তববাদী। কারা রাগ ও আবেগের সুযোগ নিচ্ছে, ভাবা উচিত।’’
সভার মতের পক্ষে ছিলেন অভিনেতা, বিজেপি নেতা রুদ্রনীল ঘোষ ও তৃণমূলের অরূপও। রুদ্রের প্রশ্ন, আর জি কর নিয়ে যতটা তীব্র আন্দোলন হয়, তা অন্য ঘটনা নিয়ে হয় কি? বিপক্ষে সিপিএমের দীপ্সিতা ধর বলেন, আর জি কর নিয়ে আন্দোলন আসলে হাথরস, উন্নাওয়ের বিরুদ্ধেও আন্দোলন। মেয়েদের প্রতি বৈষম্য নিয়ে বাড়ির বা পাড়ার কিশোরীটির সচেতনতা-পাঠও এই প্রতিবাদে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক, পরিসংখ্যানবিদ শুভময় মৈত্রের কটাক্ষ, এই আন্দোলন উদ্দেশ্যহীন হলে ১৯৯৩-এ পুলিশের গুলিতে কংগ্রেসিদের মৃত্যুর প্রতিবাদে আন্দোলন কী ছিল? আর জি কর-কাণ্ডের অন্যতম প্রতিবাদী, ডাক্তার সুবর্ণ গোস্বামী বলেন, ‘‘মিডিয়ার আলো সরলেও আন্দোলন থেমে নেই।’’
বিতর্ক নিয়ে মন্তব্য করতে এসে ১৪ অগস্টের রাত দখলের এক আহ্বায়ক রিমঝিম সিংহ বললেন, ‘‘মনে রাখতে হবে, আন্দোলনে কোনও চেনা ঝান্ডা না-থাকায় অনেকে স্বস্তি পান। এ আসলে দীর্ঘ হিংসার বিরুদ্ধে নারী, ট্রান্স, কুইয়ারদেরও আন্দোলন।’’ অবসরপ্রাপ্ত আমলা, প্রাক্তন সাংসদ জহর সরকারও তাঁর মন্তব্যে এ দেশের আজকের প্রেক্ষাপটে নাগরিক আন্দোলনকে খাটো করার প্রবণতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁর কথায়, ‘‘উদ্দেশ্যহীন আন্দোলন বলাটাও সত্য নয়। কোনও আন্দোলনকেই এক কথায় ব্যর্থ বলে দাগিয়ে দেওয়া যায় না।’’
সভার মতের বিরুদ্ধের বক্তাদের মধ্যে শুভময় ‘অক্ষম রাগ’ বা ‘অযৌক্তিক আবেগ’-এর তত্ত্ব নস্যাৎ করতে রক্তকরবীর নন্দিনীর কথা তোলেন। নন্দিনী মৃত্যুর মধ্যে রঞ্জনের অপরাজিত কণ্ঠ শুনতে পান। হাত তুলে পক্ষ বেছে নেওয়ার মুহূর্তে সম্ভবত এই আশাবাদই সঞ্চারিত হল। সভার মত উড়িয়ে বিতর্কে জয়ী এ দিনের বিরোধীরাই।