তার পরিবারের আদরের সুরক্ষা বলয় তছনছ হয়ে গিয়েছিল এক রাতেই। তিন মাস আগে পরিবারের কার্যত সবাইকে হারানোর পরে শরীরে, মনে ধ্বস্ত চোদ্দো বছর সবে ফিরছে জীবনেরকাছে। কলকাতার সরকারি হোমের আশ্রয়ে সে ভালবেসে দাবা খেলে। অল্পস্বল্প কথা বলে। তবে এখনও স্কুল বা স্বাভাবিক জীবনে পুরোটা ফিরে আসা— তার জন্য উজান ঠেলা এক যুদ্ধ। ট্যাংরার দে পরিবারের সেই ছেলেটির দায়িত্ব নিতে অবশেষে তার কাকিমার মা, বাবা এগিয়ে এসেছেন।
নিকট জনের হাতে জীবন শেষ হতে হতে বেঁচে যাওয়ার পরে চোদ্দো বছরের সেই কিশোর দেখেছিল, তার মা, কাকিমা, পিঠোপিঠি খুড়তুতো বোন নিথর হয়ে পড়ে বাড়িতে। বাবা ও কাকা তাকে নিয়েই গাড়ি দুর্ঘটনায় জীবন দিতে যান বলে জেনেছে পুলিশ। সেই খাদের মুখ থেকে ছেলেটি ফিরেছে। তার মা, কাকিমা, বোনকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত বাবা প্রণয় দে, কাকা প্রসূন দে আপাতত জেলে।
এ শহরের আর এক প্রবীণ দম্পতিও একমাত্র মেয়ে রোমি, কিশোরী নাতনিকে হারিয়েছেন। অভিযুক্ত জামাই জেলে। এক রকম নিজেদের মধ্যেই গুটিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। নতুন করে মায়ায় বাঁধা পড়তে চাননি। কিন্তু মেয়ের জায়ের সন্তান,নাতির মতোই আদরের মা-হারা কিশোরটির অসহায়তায় ষাটোর্ধ্ব দম্পতির মন গলেছে। নাবালক ঘরহারাছোটদের পরিচর্যার শরিক চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি (সিডব্লিউসি) বা শিশু কল্যাণ সমিতির (কলকাতা) কাছে চিঠি দিয়ে তার কাকিমার মা, বাবা ছেলেটির দায়িত্ব নিতে চেয়েছেন।
রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের উপদেষ্টা অনন্যা চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘সরকারি হোমে আইনি সুরক্ষা ও যত্নের জন্য আসা শিশুদের মনের ক্ষত সারাতে কাউন্সেলিং করা হয়। কিন্তু মূল স্রোতে ফেরাতে বাড়ির বিকল্প নেই। ট্যাংরার ছোট ছেলেটির কাকিমার মা, বাবাও মর্মান্তিক কষ্টের শিকার। সেই কষ্ট সয়েও ওঁরা ছেলেটিকে নিজেদের পরিবারে চাইছেন।’’ সিডব্লিউসি (কলকাতা)-র চেয়ারপার্সন মহুয়া শূর রায় বলেন, ‘‘ছেলেটির সঙ্গে তার দাদু, দিদার (কাকিমার মা, বাবা) দেখা হয়েছে। সবাইকেই খুশি মনে হল। ওই বয়স্ক দম্পতি আমাদের চিঠি দিয়ে বাচ্চা ছেলেটির দায়িত্ব নিতে চেয়েছেন। দেখছি, কত দ্রুত কাজটা সারা যায়।’’
মা খুন হওয়া ও বাবা জেলে যাওয়ারপরে ছেলেটির মামা তার দায়িত্ব নিতে চাননি। প্রথমে কাকিমার মা, বাবাও দ্বিধায় ছিলেন। ছেলেটিকে কোনও ভাল স্কুলের হস্টেলে রাখার কথাও ভাবা হচ্ছে বলে সূত্রের খবর। ছুটিতে সে তার দাদু-দিদার কাছেই থাকবে।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ট্যাংরার দে পরিবারের ঘটনা জানা যায়। পুলিশ সূত্রে দাবি, কয়েক কোটি টাকা দেনার দায়ে বিপর্যস্ত দুই ভাই প্রণয় ও প্রসূন এবং তাঁদের স্ত্রী সুদেষ্ণা ও রোমি মিলে আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। সুদেষ্ণা, রোমি এবং রোমির ছোট মেয়ের মৃত্যু নিশ্চিত হলেও বাকিরা বেঁচে যান। পুলিশ জানায়, শীঘ্রই খুনের অভিযোগে প্রণয়, প্রসূনের নামে চার্জশিট পেশ করা হবে। মা-হারা ছেলেটি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গোপন জবানবন্দি দিয়েছে। ট্যাংরার দে-বাড়ির ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীও সেই নাবালক।