জলকষ্টের শহরে টাকার জোরে ‘দুর্নীতির জল’ গড়িয়ে যায়
আনন্দবাজার | ২৬ মে ২০২৫
৭০ হাজার থেকে দু’লক্ষ! এলাকা ভেদে যেখানে, যেমন দাবি করা হবে, সেই মতো টাকা দিতে পারলেই হল। বাড়ির নির্দিষ্ট কোনও ঠিকানা আছে কিনা, দেখা হবে না। সেই ঠিকানায় চার-পাঁচতলা বহুতল তৈরির অনুমতি আছে কিনা, কেউ জানতেচাইবেন না। এ-ও জিজ্ঞাসা করা হবে না, যে পাড়ায় জলস্তর তলানিতে, সাধারণ মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে রাস্তার কল থেকে জল নিতে হচ্ছে, সেখানে একটি বাড়িতে এতগুলি জলের সংযোগ দেওয়া হয় কী ভাবে? যার বদলে অনায়াসে পাওয়া যায় সরাসরি পাম্প লাগিয়ে পুরসভার মূল লাইন থেকে জল তোলার ‘ছাড়পত্র’। দেখেওদেখা হবে না, জলস্তর তলানিতে ঠেকা এলাকায় তৈরি হওয়া আবাসনে গভীর নলকূপ বসিয়ে ভূগর্ভস্থ জল তোলার কারবার।
গরম পড়তেই পর্যাপ্ত জলের জন্য শহরের নানা প্রান্তে বাড়তে থাকা ভোগান্তির মধ্যে সামনে আসছে জল ঘিরে এমনই একাধিক দুর্নীতি। প্রতি বছর এ নিয়ে নাগরিক ক্ষোভ তৈরি হলেও সমস্যার সমাধানে পুর-প্রশাসনকে তেমন ভাবে উদ্যোগী হতে দেখা যায় না বলেই অভিযোগ। যেমন, গত বছর ‘টক টু মেয়র’ অনুষ্ঠানে এক নাগরিক তাঁদেরএলাকায় পাম্প দিয়ে পুরসভার কল থেকে বাড়ির ছাদে জল তোলার অভিযোগ করেছিলেন। তাঁর দাবি ছিল, এর জন্য এলাকায় জলের চাপ কমে গিয়েছে।সেই সময়েই মেয়র এ ভাবে পাম্প ব্যবহার বন্ধ করতে আধিকারিকদের নিয়ম-নীতি চালু করার নির্দেশ দেন। কিন্তু বাস্তবে কিছুই কাজ হয়নি বলে অভিযোগ।
পুরসভা সূত্রের খবর, নিয়ম অনুযায়ী, কলকাতা পুর এলাকায় একটি ঠিকানায় একটি মাত্র জলের সংযোগই থাকার কথা। এর বেশি সংযোগ পেতে হলে বাণিজ্যিক কারণ দেখিয়ে টাকা দিতে হয়।নিয়ম বলছে, জল খরচ বাবদ মাসিক তিন হাজার টাকা এবং পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা বাবদ জল খরচের২৫ শতাংশ আলাদা করে পুরসভাকে দিতে হয়। পুরসভার জল সরবরাহ বিভাগের এক কর্মী বলেন, ‘‘নিয়ম যা-ইথাকুক, টাকা গুঁজে দিতে পারলেই এক ঠিকানায় একাধিক জলের সংযোগ দেওয়া হয় বহু এলাকাতেই। অনেক ক্ষেত্রে আবার এমন সংযোগ দেওয়ার জন্য নেতা-মন্ত্রী, প্রভাবশালীর ফোন আসে।’’
পুরকর্তাদের একাংশের দাবি, কোনও সময়ে একটি ঠিকানায় হয়তো একটিই বাড়ি ছিল। পরে শরিকি ভাগাভাগির কারণে একাধিকঘর হয়ে গিয়েছে, কিন্তু ঠিকানা বদল হয়নি। সেখানে নিয়ম অনুযায়ী একটিই জলের সংযোগ পাওয়ার কথা। অথচ, কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে পৃথক পৃথক বাড়ি হিসাবে দেখিয়ে জলের সংযোগনেওয়া হচ্ছে। এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘এতে জলের ঘাটতির পাশাপাশি পুরসভার রাজস্ব আদায়ও মার খাচ্ছে।’’
আর এক পুর আধিকারিকের মন্তব্য, ‘‘এর চেয়েও বড় সমস্যা দেখা দেয় একটি ঠিকানায় বেআইনি ভাবে চার-পাঁচতলা বহুতল তৈরি হলে। হয়তো ওই জায়গায় আগেএকতলা বাড়িতে পাঁচটি পরিবার থাকত। কিন্তু সেখানে এখন পাঁচতলা বহুতল ওঠায় প্রতি তলে তিনটি করে মোট ১৫টি পরিবার থাকছে। পাঁচটি পরিবারের যত জল লাগে, ১৫টি পরিবারের সেই জলেই সব হতে পারে না! অথচ, বেআইনি হওয়া সত্ত্বেও সেই বাড়িতেই টাকা দিয়েজলের সংযোগ পৌঁছে যাচ্ছে। নিজস্ব রিজ়ার্ভার তৈরি করে সকলের ব্যবহারের জল ধরে রাখার নিয়মটুকু মানা হয় না। উল্টে পাম্প লাগিয়ে রাস্তার নীচ দিয়ে যাওয়া পুরসভার লাইন থেকে সরাসরি জল টেনে নেওয়া হয়।’’ অভিযোগ, এতে ভোগান্তিতে পড়েন সেই মানুষেরা, যাঁরা এখনও টালি বা টিনের ছাউনিদেওয়া বাড়িতে থাকেন। তাঁদের বাড়িতে জল পড়ে সুতোর মতো। একই অবস্থা হয় পুরসভার ‘কমিউনিটি কল’গুলিতেও।
কিন্তু এ সব কি পুরসভা জানে না? তা হলে পদক্ষেপ করা হয় না কেন? প্রশ্ন উঠলেই পুরসভার তরফে কর্মীর সঙ্কটের কথা তুলে ধরা হয়।কতগুলি শূন্য পদ রয়েছে জানিয়ে পুরকর্তারা বলেন, ‘‘দেখার লোক কই? ধরবেন কে?’’ প্রশ্ন ওঠে, যে পথেই হোক, পুরসভাকে না জানিয়ে তো সংযোগ পাওয়া সম্ভব নয়। তা হলে সংযোগ দেবেন যাঁরা, তাঁরা ধরবেন না কেন? মেয়র ফিরহাদহাকিম বলেন, ‘‘সমস্ত স্তরে কড়া বার্তা দিয়ে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেকটাই ভাল।’’