• প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের যুগের পর যুগ মাথায় চড়ালে, তা বিষাক্ত হয়ে যায়: রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে কিউ
    আনন্দবাজার | ২৩ মে ২০২৫
  • সকলের ধারণা, আমার রবীন্দ্রনাথকে একেবারেই পছন্দ নয়। এই ধারণারও কারণ রয়েছে। ‘আইকনোক্লাস্ট’ বলে একটি শব্দ রয়েছে ইংরেজিতে। কোনও বড় প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস বা ব্যক্তির বিরোধিতা করে থাকেন ‘আইকনোক্লাস্ট’রা। অনেকটা সময় ধরে যাঁরা খ্যাতি পেয়ে থাকেন, তাঁরা সেই খ্যাতির ব্যবহার কী ভাবে করছেন, অথবা তাঁদেরকে সমাজ কী ভাবে দেখছে সেগুলি নিয়ে কথা বলতে গেলে সমস্যার তৈরি হয়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও এমন বহু উদাহরণ দেওয়াই যায়। কিন্তু সেটা বলতে গেলেই লোকে প্রশ্ন তুলবে, “আপনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এমন মন্তব্য কেন করছেন!” আসলে এমন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিকে তাঁর পরের প্রজন্ম ধরেও যখন মাথায় চড়িয়ে রাখা হয়, তখন পুরো বিষয়টা খুব বিষাক্ত হয়ে দাঁড়ায়। যে বিষয়টা একটা সময়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বর্তমানে সেটাই বিষ ছড়াতে থাকে।

    আমাদের জাতির অতীতকে আঁকড়ে থাকার প্রবণতা রয়েছে। তাই তাদের আর কিছু হচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ এখন যেন চা-জলখাবারে মিশে গিয়েছেন। অথচ, রবীন্দ্রনাথকে কী ভাবে বাস্তবে প্রয়োগ করতে হয়, তা মানুষের পক্ষে বোঝা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেই বা কবিতা বললেই, চোখে জল এসে যাচ্ছে— এটা কিন্তু আবেগের উদ্রেক। বাস্তবিক নয়।

    আমি কেন ‘তাসের দেশ’ নিজের মতো করে তৈরি করেছি, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আসলে চলচ্চিত্রকে তো সম্পূর্ণ ভাবে শিল্প বলা যায় না। এটা ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট ফর্ম’। এই দুনিয়ায় অনেক ভেবেচিন্তে শিল্পের প্রয়োগ করতে হয়। আমাদের দেশে গত ৩০ বছরে তো ছবির মাধ্যমে শিল্প হয়নি। যাঁরা সেটা করতে পারতেন, তাঁদের অনেক দিন আগে মৃত্যু হয়েছে। তবে ২০০০ সালের পর থেকে প্রথম ১৫ বছর ভাল কেটেছে। এই সময়কালে স্বাধীন ভাবে কিছু সচেতন মানুষ কথা বলতে পেরেছেন। এই সময়েই আমি ‘তাসের দেশ’ বানিয়েছিলাম। ‘গান্ডু’র উন্মাদনাও সারা পৃথিবী জুড়ে চলছিল। যদিও বাংলায় এই নিয়ে কোনও কথাবার্তা হয়নি। সময়টা ভাল (ফ্লেক্সিবল) ছিল বলেই ‘তাসের দেশ’কে ভেঙেচুরে তৈরি করার সুযোগ ছাড়িনি।

    ছোট থেকে আমি ‘তাসের দেশ’ মুখস্থ বলতে পারি। সমস্ত মধ্যবিত্ত পরিবারে একটা বিষয় ছিল। তার সঙ্গে আমার বাবা ছিলেন বামপন্থী। তাই আলেকজ়ান্ডার পুশকিন থেকে রবীন্দ্রনাথ— সব পড়তে হবে, এই নিয়ম ছিল। পড়ার পরে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কার দর্শন বেছে নিতে চাই। আমরা ছোটবেলায় ‘গীতবিতান’ নিয়ে ‘বুক ক্রিকেট’ খেলতাম। বই খুলে যে কোনও পাতা বেরোলে, তার মধ্যে থেকে একটি গান অন্তত গাইতে হবে।

    একটা প্রশ্ন কি মানুষ ভাবে? রবীন্দ্রনাথকে কেন বিশ্বকবি বলা হয়? আসলে তিনি চিরন্তন সত্যের কথা বলেন। তিনি কিন্তু রাস্তার কথা বলেননি। তিনি বিরাট ব্যাপ্তির কথা বলেছেন। তাই তাঁকে মহাসনে বসানো হয়েছে। ওঁর সময়ের জন্যই তিনি এই স্থান পেয়েছেন। সময় পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সবাই একটা উদ্দেশ্যের কথাই বলছেন। ৬০ ও ৭০-এর দশকে মানুষ বুঝতে চেয়েছে স্বাধীনতা কী? তার আগেই রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়ে দিয়েছেন স্বাধীনতা কেন চাই? রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, প্রেমেন্দ্র মিত্রেরা স্বাধীনতার কথা প্রতিষ্ঠিত (এস্টাব্লিশড) করে দেওয়ার পরেই ৬০ ও ৭০-এর দশকের মানুষ অন্য এক স্বাধীনতার কথা বলতে পেরেছে। ‘তাসের দেশ’ও স্বাধীনতার কথা বলে। তাই এই একটি কাজ সব সময়ে আমাকে আকৃষ্ট করেছে।

    বেশ কয়েক বছর ধরে রবীন্দ্র রচনাবলির অংশ ছিল না ‘তাসের দেশ’। বিশ্বকবির সত্তা বা ভাবমূর্তি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যেগুলি লিখেছেন, তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ‘তাসের দেশ’। এটা কিন্তু গীতিনাট্যও না। আবার নৃত্যনাট্যও নয়। এটা রবীন্দ্রনাথের একেবারেই স্বতন্ত্র পরীক্ষামূলক কাজ। প্রথমে ১৯ বছর বয়সে ‘তাসের দেশ’ লিখেছিলেন। পরে দু’বার সেখানে অন্য অনেক কিছুর সংযোজন হয়। পরের দিকে এই কাজকেও সেই চিরন্তন সত্যের দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই কাজের মূল বিষয়বস্তুই হল স্বাধীনতার কথা বলা। রবীন্দ্রনাথের কাজে কিন্তু কৌতুক খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু এই তাসের চরিত্রগুলির মধ্যে ‘রিফাইন্ড স্যাটায়ার’ খুঁজে পাই।

    যুগ প্রযুক্তিগত দিক থেকে তো এগোচ্ছেই। রোদ্দুর রায় ও রবীন্দ্রনাথ এক সঙ্গে চা খাচ্ছেন— এমন ছবি তো ‘ভাইরাল’। আসলে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ রয়েছেন, যাঁরা সেই অতীত আঁক়ড়ে রয়েছেন। নতুন প্রজন্ম কিন্তু এগিয়ে চলেছে। ৩০ ও ৪০-এর দশকের ‘কল্লোল শ্রেণি’ নামে একটি গোষ্ঠী ছিল। ‘কল্লোল’ নামে একটি ক্রোড়পত্রে সেই গোষ্ঠীর সদস্যেরা নিয়মিত রবীন্দ্রবিরোধী লেখালিখি করতেন। বুর্জোয়া শিল্পের বিরোধিতা করাই ছিল এই গোষ্ঠীর মূল্য উদ্দেশ্য। কিন্তু এই বিরোধিতায় রবীন্দ্রনাথের কোনও অসুবিধা হয়নি। তিনি কোনও আপত্তিও জানাননি। কিন্তু আজ কেউ ‘কল্লোল’-এর মতো একটা ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে দেখুক!

    মূল স্রোতের বিপরীতে কেউ বক্তব্য রাখলেই সমস্যা তৈরি হচ্ছে। সমাজের সব দিক তুলে ধরা তো আমাদের দায়িত্ব। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তো ব্রিটিশ শাসনের সময়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তখন কি তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “আপনি মূল স্রোতের বিপরীতে মুখ খুলছেন কেন?” অদ্ভুত ব্যাপার, রবীন্দ্রনাথের পুজো হয়েছে। কিন্তু এই বিষয়গুলো আমরা রবীন্দ্রনাথের থেকে শিখতে পারিনি। সারা পৃথিবীতে আমি কিছুটা হলেও পরিচিতি পেয়েছি। কিন্তু নিজের জায়গায় পাইনি। তার একটাই কারণ। আমি বাবা-জ্যাঠা গোছের লোকেদের গালাগাল দিয়েছি ও মূলস্রোতের বিপরীতে কথা বলেছি।

    রবীন্দ্রবিরোধিতা করলে কিছু মানুষ রে-রে করে ওঠেন। এরাও কিন্তু আদ্যোপান্ত দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্টই। এরা ভাবে, এদের রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিরাট প্রেম। কিন্তু এরাই সংখ্যালঘুদের অপছন্দ করে। এরা নিজেদের সবার উপরে মনে করে। তার উপরে শুধু রবীন্দ্রনাথ। এরাও এক ধরনের ভক্ত।

    আমার গুরু হলেন নবারুণ ভট্টচার্য। তাঁর লেখা একটি পংক্তি খুব মনে পড়ে এই প্রসঙ্গে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, “জাহাজ ক্যাপ্টেন তুমি, বাকি সব মাঝি আর মাল্লা সকলে জাঙিয়া পরা, একা তুমি পরে আলখাল্লা”। তবে রবীন্দ্রনাথকে আর প্রয়োজন নেই এটা বলা যায় না। যেমন ভাবে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ়কে দরকার, তেমন ভাবেই রবীন্দ্রনাথকে দরকার। রবীন্দ্রনাথকে জানতে হবে। ওঁকে পড়লেই ওঁর সময়টাকে বোঝা যাবে। ওঁর সময় না বুঝলে, নিজের সময়টাকে বুঝতে পারব না। রবীন্দ্রনাথ শান্তিবাদী। বিশ্বশান্তির কথা বলেছেন। তাই ওঁর দর্শন আজও জানতে হবে। যদিও বিশ্বশান্তি আজ অলীক স্বপ্নের মতোই।

    মনের মধ্যে বারুদ না থাকলে যুগান্তকারী হওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ ২০০ বছর এগিয়ে। তবে অনেকেই রবীন্দ্রনাথের কাজ নতুন করে করছে। আসলে রবীন্দ্রনাথকে ছুঁয়ে না গেলে ভাল বাঙালিই হয়ে ওঠা যায় না। সেই অপরাধবোধ থেকে অনেকে কাজ করছেন এবং ছড়িয়ে ফেলছেন। আমার আর রবীন্দ্রনাথের অন্য কোনও কাজ নিয়ে ছবি করার কোনও ইচ্ছে নেই। কেবল ওঁর স্বাধীনতার বার্তাটুকুই আমার কাজে থাকতে পারে।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)