মুর্শিদাবাদে অশান্তির ঘটনার পর থেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল বিজেপি। এ বার কলকাতা হাই কোর্টের নিযুক্ত তথ্যানুসন্ধান কমিটির রিপোর্টকে হাতিয়ার করে আরও তেড়েফুঁড়ে ময়দানে নামল তারা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন ও দলকে ‘হিন্দু-বিরোধী’ আখ্যা দিয়ে সর্বভারতীয় স্তরেও প্রচার শুরু করল তারা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা অবশ্য বুধবারই উত্তরবঙ্গে প্রশাসনিক বৈঠকে মালদহের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ‘‘গোষ্ঠী-সংঘর্ষ কেন হয়? কেউ করলেই আমাকে করতে হবে? কেউ তো করবেই । আমরা কেন করব? জেলাশাসক, পুলিস সুপারদের ভাল করে নজর রাখতে হবে।’’
ওয়াকফ-প্রতিবাদকে ঘিরে মুর্শিদাবাদে অশান্তি, সম্পত্তি নষ্ট ও প্রাণহানির ঘটনার পরে আদালতে মামলার প্রেক্ষিতে তিন সদস্যের একটি তথ্যানুসন্ধান দল তৈরি করে দিয়েছিল হাই কোর্ট। দলে ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, ‘লিগ্যাল সার্ভিসেস অথরিটি এবং হাই কোর্টের এক জন করে প্রতিনিধি। কমিটির রিপোর্টে উঠে এসেছে, শমসেরগঞ্জে হামলার সময়ে পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল। বারবার ফোন পেয়েও তারা সক্রিয় হয়নি। ধুলিয়ান পুরসভার প্রাক্তন পুরপ্রধান-সহ কয়েক জনের ভূমিকা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা গুরুতর অভিযোগ করেছেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে।
কোর্টের কমিটির এই রিপোর্টের প্রেক্ষিতে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, ‘‘লাজ-লজ্জা থাকলে পুলিশমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত। আমরা যা বলছি, হাই কোর্ট নিযুক্ত কমিটি সে কথাই বলেছে। তৃণমূলের পুর-প্রতিনিধি, তৃণমূলের বিধায়ক গোলমাল লাগিয়ে এলাকা ছেড়েছেন। হিন্দু নিধনে তৃণমূল কংগ্রেস স্পনসর করছে!’’ সরব হয়েছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারও।
দিল্লিতে দলের সদর দফতর থেকেও সরব হয়েছে বিজেপি। দলের মুখপাত্র সুধাংশু ত্রিবেদী দিল্লিতে সাংবাদিক সম্মেলন করে পহেলগামের ঘটনার সঙ্গে মুর্শিদাবাদের হিংসার তুলনা টেনেছেন। তাঁর বক্তব্য, দুই ক্ষেত্রেই ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে মানুষকে নিশানা করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্টে স্পষ্ট, হিংসায় তৃণমূলের নেতারা যুক্ত ছিলেন। রাজ্য পুলিশ নিষ্ক্রিয় হয়ে বসেছিল।
তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ অবশ্য পাল্টা বলেছেন, ‘‘অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন দেশের কথা বলতে বিদেশে রওনা হয়েছেন, সেই সময়ে বিজেপি বিদ্বেষমূলক প্রচারে বিষ ছড়ানোর চেষ্টা করছে। দেশ নয়, বাংলার প্রতি রাজনৈতিক বিদ্বেষই বিজেপির কাছে বড়। দলীয় নেতৃত্ব এই রিপোর্ট পর্যালোচনা করবে।’’
হাই কোর্টের কমিটির রিপোর্টে নাম রয়েছে ধুলিয়ানের প্রাক্তন পুর-প্রধান, তৃণমূলের মেহবুব আলমের। তাঁর স্ত্রী রোশনারা বিবি এখন ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল পুর-প্রতিনিধি। হিংসায় সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই ওয়ার্ডের বেতবোনা পল্লী। মেহবুব এ দিন বলেছেন, “আদালতকে আমি সম্মান করি। কিন্তু যে অভিযোগটা আমার বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। যে দিন ঘটনাটি ঘটে, সে দিন আমি ছিলাম কদমতলায়। আমার সঙ্গে চার জন অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও ছিলেন। সেখানে দেখতে পাই, কিছু দুষ্কৃতী হাতে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে আসছে । আমরা তাদের বাধা দিতে গিয়েছিলাম, তারা আক্রমণ করে। আমরা তখন পাশের নাদাবপাড়াতে ঢুকে পড়ি। জোসেফ নাদাবের বাড়িতে আশ্রয় নিই।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘পাশেই বাড়ি বিকাশ সরকার ও মানিক সরকারের। সেখান থেকেই তৎকালীন ওসি-কে ফোন করলে প্রথমে ধরেননি। পরে এক বার ফোন ধরে বলেন, দেখছি। কিন্তু কিছুই করেননি তিনি।’’ মেহবুবের দাবি, ‘‘এ সব বিজেপি-আরএসএসের চক্রান্ত। বেতবোনার মানুষকে দিয়ে তারা আমার বিরুদ্ধে কথা বলিয়েছে।’’
সরব হয়েছে সিপিএম ও কংগ্রেসও। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর তো পদত্যাগ করা উচিত। আর অন্তত ১৪ জন যে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, বিএসএফের পোশাকে কারা গুলি চালিয়েছে, সে সবও তদন্তের আওতায় আসা উচিত।’’ কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর দাবি, ‘‘বাবা-ছেলে খুন হওয়ার দিনে স্থানীয় মানুষ পুলিশের সাহায্য চেয়েও পাননি। একটি সম্প্রদায়ের উপরে আক্রমণ নিয়ে হইচই শুরু হতে পুলিশ-প্রশাসনকে দিয়ে অন্য সম্প্রদায়ের এলাকায় হামলা করিয়ে দেওয়া হয়েছে।’’