• পুলিশমন্ত্রী মমতার রোষানলে পড়তে হল পুলিশকেই! উত্তরের প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর ধমক শুনলেন ডিজি রাজীবও
    আনন্দবাজার | ২২ মে ২০২৫
  • আইনশৃঙ্খলা ‘ভেঙে পড়া’, পুলিশের ‘নিষ্ক্রিয়তা’ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের ভূমিকা প্রসঙ্গে বিরোধীদের সমালোচনা চলতেই থাকে। কিন্তু উত্তরবঙ্গের প্রশাসনিক বৈঠকে পুলিশমন্ত্রী মমতারই রোষে পড়তে হল পুলিশকর্তাদের। মমতার ধমক থেকে বাদ পড়লেন না রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমারও। জেলা স্তরে প্রশাসনিক বৈঠকে পুলিশের নানা স্তরের কাজকর্ম নিয়ে মমতার উষ্মাপ্রকাশ নতুন নয়। কিন্তু স্বয়ং ডিজি-র কাজকর্ম নিয়ে প্রকাশ্যে মমতা যে ভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন, তা সাম্প্রতিক সময়ে হয়নি।

    উত্তরবঙ্গের ৮টি জেলার প্রশাসনকে নিয়ে বুধবার উত্তরকন্যায় বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। শুরুতেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ঠেকাতে পুলিশের ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দেন মমতা। উত্তরবঙ্গের একাধিক জেলায় আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে। সেই সব এলাকা সম্পর্কে মমতা বলেন, ‘‘বর্ডার এলাকা খুব সেনসিটিভ (স্পর্শকাতর)। সেটা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।’’ এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে মমতা তাঁর বাহিনীকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেবেন, সেটাই দস্তুর। কিন্তু আলোচনা জেলাওয়ারি শুরু হতেই বোঝা যায়, পুলিশের বিষয়ে ‘খোঁজখবর’ নিয়েই মুখ্যমন্ত্রী বৈঠকে বসেছেন।

    কোচবিহারের পুলিশ সুপার দ্যুতিমান ভট্টাচার্যকে মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘চন্দনবাবু কে আছেন?’’ এসপি জানান, তিনি বৈঠকে আসেননি। মমতা পাল্টা জানতে চান, ‘‘কেন আসেননি?’’ জবাব শোনার আগেই বাকিটা বলতে থাকেন মমতা নিজেই। তাঁর কথায়, ‘‘ওঁকে (চন্দন দাস) কোচবিহারের ডিএসপি হেডকোয়াটার্স করে রাখা হয়েছে। কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। তোমরা ওঁকে কাজ করতে দাও না।’’ এর পর সরাসরি পুলিশের মধ্যে গোষ্ঠীবাজির অভিযোগ করেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘তোমরা নিজেরাই যদি নিজেদের মধ্যে গ্রুপ করে নাও, তা হলে কী হবে? সে কাজ করতে চায়, তবু কাজ করতে দেবে না, এ আবার কী? পুলিশ কি নিজেদের মধ্যে গ্রুপ করে? গ্রুপ তো পলিটিক্যাল লিডারেরা করে। এটাই জেনে এসেছি।’’

    তাঁকে নিয়ে যে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বৈঠকে মুখ খুলেছেন, তা জানেন চন্দনও। তবে প্রত্যাশিত ভাবেই তিনি ওই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমি শিলিগুড়ির বৈঠকে যাইনি। ভার্চুয়ালি ছিলাম। তবে মুখ্যমন্ত্রীর কথা প্রসঙ্গে আমি কোনও মন্তব্য করব না। এটা পুলিশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।’’

    আরও এক পুলিশকর্তার নাম নিয়ে সতর্ক করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে তিনি কোন জেলার, কী পদে রয়েছেন, তা বলেননি। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘নীরজ সিংহ কে আছেন? তাঁর সম্পর্কে অনেক অভিযোগ আসছে। কী অভিযোগ সেগুলো আর এখানে বলছি না। বর্ডার কিন্তু ভাল করে দেখে রাখতে হবে।’’

    বৈঠকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার জনপ্রতিনিধিদেরও কথা শুনছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। নিজের বক্তব্য বলতে উঠে একটি অভিযোগ করেন কোচবিহারের তৃণমূল সাংসদ জগদীশচন্দ্র বসুনিয়া। তাতেই ডিজি-কে ধমক দেন মমতা। জগদীশ বলেন, ‘‘আমি গ্রামেগঞ্জে ঘুরে দেখছি, এক দিকে নতুন রাস্তা তৈরি হচ্ছে। অন্য দিকে ভারী ট্রাক ঢুকে রাস্তা ভেঙে দিচ্ছে।’’ শুনেই মমতা বলেন, ‘‘আমি তো কত বার বলেছি যে, গ্রামের রাস্তায় ওভারলোডেড ট্রাক ঢুকবে না! তার পরেও কেন হচ্ছে?’’ তার পর ডিজি-র উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘রাজীব, আমি কত বার বলব এক কথা? হাউ মেনি টাইম্‌‌স? এক কথা বার বার বলতে ভাল লাগে না! কেউ টাকা খেয়ে গ্রামীণ রাস্তায় ট্রাক ঢোকাবে, সেটা চলবে না। আইসি-রা কী করছে? এটা তো দেখার কথা ডিজি-র।’’ মাইক্রোফোন মুখের থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে (যদিও তাঁর কথা শোনা গিয়েছে) মুখ্যমন্ত্রী ফের বলেন, ‘‘কিছুতেই কথা শোনে না এরা!’’ রাজীব খানিক নিচু স্বরে মুখ্যমন্ত্রীকে বলেন, ‘‘আমি দেখে নিচ্ছি ম্যাম!’’ মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য তাতেও সন্তুষ্ট হননি। রাজীবের উদ্দেশে ফের বলেন, ‘‘আর দেখে নিচ্ছ! বলতে বলতে তো আমার জিভটাই ক্ষয়ে গেল! সব জেলায় এই সমস্যা!’’ তবে জগদীশচন্দ্র ‘সঠিক’ সমস্যা তুলে ধরায় তাঁর প্রশংসাও করেন মুখ্যমন্ত্রী।

    প্রসঙ্গত, রাজ্য প্রশাসনে রাজীবের পরিচয় তিনি মুখ্যমন্ত্রীর ‘আস্থাভাজন’। ২০১৯ সালে তৎকালীন কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীবের লাউডন স্ট্রিটের বাংলোয় হানা দিয়েছিল সিবিআই। পাল্টা সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে ধর্মতলায় ধর্নায় বসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা স্বয়ং। তার পরে রাজীব পুলিশে নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়েছেন। কিন্তু মমতার সঙ্গে তাঁর আস্থার সম্পর্ক অটুট থেকেছে। তাঁকেই প্রকাশ্যে মমতার এমন ভর্ৎসনা নিয়ে স্বভাবতই জল্পনা তৈরি হয়েছে। যদিও প্রশাসনের অনেকের বক্তব্য, এটি নির্দিষ্ট একটি ঘটনার সাপেক্ষে মুখ্যমন্ত্রীর স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া। এর সঙ্গে আস্থা-অনাস্থার কোনও সম্পর্ক নেই। অন্য একটি অংশের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী দক্ষ অফিসার হিসাবে রাজীবের উপর নির্ভর করেন। আশা করেন সমস্ত সমস্যা রাজীব সমাধান করে দেবেন। সেই প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ না হলে হতাশ হন। এটা সেই হতাশার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু তাতে রাজীবের কাছে তাঁর প্রত্যাশা কমবে না। রাজীবের উপর তাঁর ভরসা নেই, এমনও নয়।

    রাস্তা ভাঙা নিয়ে তাঁর ক্ষোভ কেন, তা-ও ব্যাখ্যা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। জানান, গ্রামসড়ক যোজনায় গত চার বছর ধরে রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ পাচ্ছে না। রাজ্যের কোষাগার থেকেই ‘পথশ্রী’ প্রকল্প চালু করেছে নবান্ন। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘অনেক কষ্ট করে রাজ্যের অর্থে রাস্তা নির্মাণ হচ্ছে। সেই রাস্তা যদি ট্রাক ঢুকে ভেঙে দেয়, তা হলে টাকা জলে যায়।’’

    মুর্শিদাবাদের আগে মালদহের মোথাবাড়িতে হিংসার ঘটনা ঘটেছিল। সেই প্রসঙ্গ টেনে মালদহ পুলিশকেও সতর্ক করেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘মালদহেই হিংসা কেন হয়? অপারেশন দাঙ্গা কেন হবে? কোথাও যেন কমিউনাল টেনশন (সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা) না হয়। আইবি-কে আরও অ্যাক্টিভ (সক্রিয়) হতে হবে। এই কারণেই ভিলেজ পুলিশ তৈরি করা হয়েছিল।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)