আলোক সোম
গত ২৯.০৪.২৪ খড়গ্রমের নির্বাচনী জনসভা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তোলেন, ‘মুর্শিদাবাদের মানুষ কি সিপিএমের অত্যাচার ভুলে গেলেন? ভোট ভাগ করবেন না৷’ তাঁর দাবি, ‘পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির দুটি চোখ? বাম এবং কংগ্রেস, কেন্দ্র ওদের কোনওদিনই এজেন্সি দিয়ে স্পর্শ করে না৷’ মহম্মদ সেলিম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মুর্শিদাবাদে বাজপাখি এসেছে ভোট কাটতে৷ আমি জাকির ও খলিলুরকে বলছি বিষয়টা দেখতে হবে৷’ সেলিমের প্রতিক্রিয়া, ‘বাজপাখি বলেছে, তাতে আমার আপত্তি নেই৷ বাজ মানে শিকারি পাখি৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরএসএসের পোষা পায়রা, মোদির খোপে থাকে৷’
ঘটনা হচ্ছে, সিপিএমই আরএসএসের পোষা পায়রা, একসময় ওরা বাজপেয়ীর খোপে ছিলেন, এখন আছেন মোদির খোপে৷
বিতর্কিত বোফর্স ইসু্যতে রাজীব গান্ধিকে উৎখাতের জন্য ১৯৮৯ সালে ভি পি সিং এবং অটলবিহারী বাজপেয়ীকে নিয়ে কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বড় মিটিং করেছিলেন জ্যোতি বসু৷ ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধি চোর হ্যায়’? স্লোগানে কলকাতার দেওয়াল ভরিয়ে দিয়েছিল সিপিএম৷ তখনও সারা দেশে প্রায় অচ্ছুৎ সাম্প্রদায়িক দলটি তাদের সমর্থনেই রাজনীতির মূল স্রোতে ঢুকে গিয়েছিল৷ সংসদে এক লাফে ২ থেকে ৮৮-তে পেঁৗছে গিয়েছিল৷ কংগ্রেস ক্ষমতাচু্যত হয়েছিল৷ তারপর থেকে বিজেপিকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি৷
মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-২ সরকারকে উৎখাতের জন্যও সিপিএম কীরকম একই কায়দায় আক্রমণ শানিয়েছিল তার গুটিকয় নমুনা পেশ করা যেতে পারে৷
২৩.১১.২০১০ সিপিএমের দৈনিক মুখপত্রের রবিবারের পাতায় ‘কেলেঙ্কারির সরকার’ শিরোনামে স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের জমি নিয়ে কেলেঙ্কারি এবং কমনওয়েলথ গেমসে দুর্নীতির অভিযোগে কাঠগড়ায় তুলেছিল মনমোহন সিংয়ের সরকারকে৷
০১.১২.২০১০ ‘দুর্নীতি, দুর্নীতি, আরও দুর্নীতি’ কেলেঙ্কারির কুম্ভীপাকে ইউপিএ-২ সরকার’ শিরোনামে তারা একটি আস্ত বই-ই ছেপে ফেলেছিল৷ বিভিন্ন কেলেঙ্কারির অভিযোগে সরাসরি মনমোহন সিংকে বিদ্ধ করে সিপিএম লিখেছিল, ‘সারা দেশ এখন এই প্রশ্নে তোলপাড় হচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী নিজে এই কেলেঙ্কারির কথা জানতেন কি? হঁ্যা, তিনি সব জানতেন৷ ক্যাগের রিপোর্ট এবং টেলিকম মন্ত্রকের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টে যে হলফনামা জমা দেওয়া হয়েছে তার বয়ান অনুযায়ী বলা যায় যে প্রধানমন্ত্রীর জ্ঞাতসারেই সব কিছু হয়েছে৷’
১৮.০৮.২০১২ সিপিএম দলীয় দৈনিক ‘কেলেঙ্কারির পাঁকে কেন্দ্র’ শিরোনামে আরও তিনটি গুরুতর অভিযোগ দায়ের করেছিল৷ ‘কয়লা খাদান বণ্টনে রাজস্ব ক্ষতি ১.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা, নিয়মের তোয়াক্কা না করেই খনি বণ্টন, বেসরকারি সংস্থার বিপুল লাভ৷ তির প্রধানমন্ত্রীর দিকে৷’
‘জলের দরে দিল্লি বিমানবন্দরের জমি বেসরকারি সংস্থা জিএমআরকে৷ রাজস্ব ক্ষতি ১,৬৩,৫৫৭ কোটি টাকা, অস্বচ্ছতা বরাত নিয়েও৷’
‘নিয়ম বহির্ভূতভাবে একটি খনির উদ্বৃত্ত কয়লা অন্য খাতে ব্যবহার করার সুযোগ করে দেওয়ায় রিলায়েন্স পাওয়ার সংস্থার ২৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি মুনাফা৷ বেনিয়ম করেছে মন্ত্রীগোষ্ঠী৷’
০২.০২.২০১৪, হাইভোল্টেজ লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে দলীয় দৈনিকের রবিবারের পাতায় সিপিএম আরও জোরালো আঘাত হেনেছিল কংগ্রেসকে, ‘ধান্দার ধনতন্ত্র যখন বেপরোয়া, লুঠ প্রাকৃতিক সম্পদ’ শিরোনামের দীর্ঘ প্রতিবেদনে৷
‘কয়লা কেলেঙ্কারি’, ‘কে জি বেসিন কেলেঙ্কারি’, ‘স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি’ শীর্ষক তিনটি স্বতন্ত্র প্রতিবেদনে ভুরি ভুরি তথ্য সহযোগে তারা পার্টি ট্রায়ালে মনমোহন সিং এবং তাঁর সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল৷ তাদের সেই সময়ের ভুবনবিদিত প্রচার কৌশলে আসমুদ্র হিমাচল কেঁপে গিয়েছিল৷ তারই অভিঘাতে পতন হয়েছিল মনমোহন সিং সরকারের৷ ক্ষমতায় এসেছিলেন নরেন্দ্র মোদি৷ তারপর থেকে আর মোদিনন্দনকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি৷
এখন তাঁর অশ্বমেধের ঘোড়ার লাগামটা এই মুলুকে একা ধরে রেখেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তাই তাঁকে সরিয়ে নরেন্দ্র মোদির পথ প্রশস্ত করার জন্য সেলিমরা জোট বেঁধেছিল অধীর চৌধুরীর সঙ্গে৷ কোন অধীর? একদা প্রায় দুই ডজন খুনের অভিযোগে যাকে জেলের ঘানি টানিয়েছিলেন সেলিমরা৷ এই অধীরের সেই কীর্তির দু’একটা নমুনা পেশ করা যেতে পারে৷
০৯.০৯.২০০৭ দলীয় দৈনিক মুখপত্রে ‘খুনের মামলায় ১২ দিনের জেল হেফাজতে অধীর’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে সিপিএম লিখছে, ‘আগামী ২০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীকে জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আদালত৷ কেতুগ্রামের মৌগ্রামে পঞ্চায়েত সদস্য, সিপিআই(এম)-র আঞ্চলিক কমিটির সদস্য কমরেড গোবর্ধন ঘোষকে খুনের অভিযোগে শুক্রবার পুলিশ অধীর চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে৷ শনিবার তাকে কাটোয়া আদালতে হাজির করা হয়৷ এসিজেএম দীপালি শ্রীবাস্তব অধীর চৌধুরীর জামিনের আবেদন নাকচ করে দেন৷ এদিনই তাকে নিজের বাড়ির অদূরে বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ আগামী ১২ দিন ওই কংগ্রেসী সাংসদের সেখানেই কাটবে৷’
সিপিএম আরও লিখছে, ‘নেতার ১২ দিনের কারাবাসের নির্দেশে যথারীতি খেপে যায় কংগ্রেস কর্মীরা৷ উত্তেজিত তারা এদিন জড়ো হয়েছিল কাটোয়া আদালত চত্বরে৷ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় প্রচুর পুলিশও মোতায়েন ছিল৷ বিচারপতির নির্দেশ শুনেই কংগ্রেস কর্মীরা স্ব-স্ব মূর্তি ধারণ করে৷ এজলাসের জানালায় ইট পাটকেল ছোঁড়ে৷ ভেঙে যায় জানালার কাচ৷ পুলিশ এই ক্ষেত্রে অবস্থা আয়ত্তে আনলে কংগ্রেস কর্মীদের রোষ গিয়ে পড়ে সাংবাদিকদের ওপর৷ হামলা হয় ২৪ ঘণ্টা নিউজ চ্যানেলের গাড়িতে৷ অশ্রাব্য গালিগালাজসহ হুমকি দেওয়া হয় সাংবাদিকদের৷ পুলিশ সাংবাদিকদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যায়৷’
সিপিএম দলীয় দৈনিক মুখপত্রে ১০.০৯.২০০৭ তারিখ থেকে ‘অপরাধের নেতা’ শিরোনামে তিনদিন ধরে অধীরের অপরাধের ফিরিস্তি ছাপে৷ প্রথম দিনের ফিরিস্তির শিরোনাম ‘রাজসিংহাসন থেকে ফের জেলে অধীর’৷ অধীরের রাজসিংহাসনে আরোহনের বৃত্তান্ত পেশ করে সিপিএম লিখছে, ‘গত আড়াই দশকে মুর্শিদাবাদে বেশ কিছু মানুষ খুন হয়েছেন যার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে অধীর চৌধুরীর এবং তাঁর অনুগামীদের নাম৷ কখনও তাঁর চোখে সন্দেহভাজন, অপছন্দের তালিকায় রয়েছেন এমন মানুষ খুন হয়েছেন৷ আবার কখনও খুন হয়েছেন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যাঁরা অধীরের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন৷ নেতার বিরুদ্ধে প্রথম খুনের অভিযোগ ওঠে বহরমপুর থানার কেস নং ১৮, ১২/৬/৮২, খুন হয় কানাই ভট্টাচার্য পাড়ার দিলীপ সাহার ছেলে বাবু সাহা৷ সেই শুরু৷ তারপর সর্বশেষ ঘটনা ২০০৫ সালে ২৪শে জুলাই রাত ১১টা নাগাদ বহরমপুর সদর হাসপাতাল লাগোয়া একটি হোটেলে খুন হন হোটেল মালিক হানিফ শেখ (৫০) এবং তাঁর ছেলে লাল্টু শেখ (২৬)৷ পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ দিল্লিতে সরকারি বাসভবন থেকে অধীর চৌধুরীকে গ্রেফতার করে৷ ২০শে নভেম্বর মুর্শিদাবাদের সিজেএম আদালতের নির্দেশে নেতার জেল হাজত হয়৷’
১১.০৯.২০০৭ তারিখের দ্বিতীয় কিস্তিতে ‘মরতে আর ভয় নেই বলে অধীরের ফাঁসিই চান মাঞ্জু’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সিপিএম ‘অধীর চৌধুরী ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের অপরাধের খতিয়ান’ পেশ করে৷ সেখানে ১৯৮২ সাল থেকে ২০০৬ সাল অবধি ১৩টি ঘটনায় ২০টি খুনের বিস্তারিত তথ্য পেশ করা হয়েছে৷ প্রতিবেদনের শেষে সিপিএম লিখছে, ‘১৯৮২ সাল থেকে এ পর্যন্ত অধিকাংশ মামলাতেই সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে নেতা খালাস পেয়েই চলেছেন৷ এবারও কি তাই? মাঞ্জু বেওয়া তাকিয়ে আছেন হাইকোর্টের দিকে৷’
১৯.০৯.২০০৭ এর তৃতীয় কিস্তির শিরোনাম ‘দলেই এখন প্রায় কোণঠাসা কং সাংসদ’৷ সিপিএম লিখছে, ‘গত শতকের নব্বই দশক৷ একেবারে গোড়ার দিকে কথা৷ ততদিনে অপরাধ জগতে অধীর চৌধুরীর নাম এক বাক্যে উঠে এসেছে৷ অঢেল অর্থ, কিছু লোকলস্কর রয়েছে, কিন্ত্ত নেই কোনও শক্তসমর্থ রাজনৈতিক আশ্রয়দাতা৷ কচুরিপানার মতো ভেসে বেড়াচ্ছেন৷ অতীশ সিনহা, মায়ারানি পালরা নজর রাখছেন৷ কিন্ত্ত সরাসরি আশ্রয় দিচ্ছেন না৷ কারণ ইতোমধ্যেই যে এক ডজন মামলা চেপে বসেছে অধীরের ঘাড়ে৷ যার অধিকাংশই খুনের মামলা৷ শেষ পর্যন্ত অধীর চৌধুরী পেয়ে গেলেন রাজনৈতিক আশ্রয়৷ ১৯৯১ সাল, মমতা ব্যানার্জি তখন কংগ্রেসে৷ তিনিই প্রথম আশ্রয় দিলেন অধীরকে৷ মমতা ব্যানার্জি শুধু যে আশ্রয় দিলেন তাই নয়, ১৯৯১ সালেই বিধানসভা নিবাচনে নবগ্রাম কেন্দ্র থেকে প্রার্থী করলেন অধীর চৌধুরীকে৷ কিন্ত্ত সিপিআই(এম)-র শিশির সরকারের কাছে ওই বার হেরে গেলেন অধীর চৌধুরী৷ এই তাঁর কংগ্রেসের ঘরে প্রবেশ৷’
কংগ্রেসের ঘরে মৌরসীপাট্টা কায়েমের কাহিনি পেশ করে উপসংহারে সিপিএম লিখছে, ‘এতো খুন, রাহাজানির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেসের ওই সাংসদ এখনও কী করে বহাল তবিয়তে রয়েছেন? এ প্রশ্ন যেমন লোকের মুখে মুখে, তেমনি দলের মধ্যে এতো বিরোধিতা সত্ত্বেও কী করে এখনও জেলা কংগ্রেসের সভাপতি রয়েছেন? এ প্রশ্নও এখন লাখ টাকার প্রশ্ন৷ অধীর এখন প্রণব মুখার্জির আশ্রয়ে৷ প্রণব মুখার্জি আগে নির্বাচনে জেতেননি৷ সর্বপ্রথম তিনি গত লোকসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর আসন থেকে জয়ী হন৷ ২০০৯ সালে আবার লোকসভার নির্বাচন৷ যদি তিনি জঙ্গিপুর আসনেই ফের দাঁড়ান তাহলে প্রয়োজন হবে অধীরকে৷ অতএব এই অচলাবস্থা চলে চলুক, গুরু-শিষ্যে আপাতত বিবাদ না হওয়াই ভালো৷’
অদৃষ্টের পরিহাস, আজ সেই অধীরের আশ্রয়েই গিয়ে উঠেছেন মহম্মদ সেলিম মুর্শিদাবাদ আসনটি হাসিল করার জন্য৷
কিন্ত্ত তিনি কি জিততে গেছেন, নাকি সংখ্যালঘু ভোট কেটে অসানটি বিজেপিকে উপহার দিতে গেছেন? অন্তত এমনই অভিযোগ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের৷ সেই অভিযোগে কার্যত শিলমোহর দিয়েছেন স্বয়ং অধীর চৌধুরী৷ ৩০ এপ্রিল জঙ্গিপুরের নির্বাচনী জনসভায় কংগ্রেস প্রার্থী মুর্তাজা হোসেনের সমর্থনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘তৃণমূলের চেয়ে ভালো বিজেপিকে ভোট দেওয়া৷’
নরেন্দ্র মোদির খোপে বসার বাধ্যবাধকতা আছে সিপিএমের৷ এক দশক ধরে চিটফান্ডের উদ্ভব এবং উত্থানের পিছনে তাদের নেতামন্ত্রীদের বিপুল পৃষ্ঠপোষকতা থাকলেও ‘কেন্দ্র ওদের কোনও দিনই এজেন্সি দিয়ে স্পর্শ করে না’? যেমনটি অভিযোগ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ সুতরাং সেলিম যে সংখ্যালঘু ভোট কেটে আসনটি বিজেপিকে উপঢৌকন দেওয়ার চেষ্টা করবেন এতে আশ্চর্যের কিছু নেই৷ কিন্ত্ত অধীর কেন বিজেপির হয়ে ভোট ভিক্ষা করছেন, সেটা এক রহস্য! বিজেপি কি জঙ্গিপুরের বিনিময়ে বহরমপুর আসনটি অধীরকে ছেড়ে দিচ্ছে? এর জবাব পাওয়া যাবে জুন মাসের চার তারিখে৷