• পনেরো বছর পরে বাবাকে ফিরে পেল জিশান-সুহানা
    আনন্দবাজার | ২৯ এপ্রিল ২০২৪
  • বাবা যখন নিখোঁজ হয়েছিলেন, তখন সুহানা সদ্যোজাত। দাদা জিশানের বয়স তখন মেরেকেটে আট। সেই অর্থে কেউই বাবার আদর-ভালবাসা পায়নি।

    জিশান এখন কলেজে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। সেলাই কারখানায় কাজও করে। পনেরো বছরের সুহানা নবম শ্রেণিতে পড়ে। ২০০৭ সালে তাঁদের মা আফসানার মৃত্যু হয়েছিল। কোনও ভাবে গায়ে আগুন লেগে অগ্নিদগ্ধ হন তিনি।

    দীর্ঘ দিন বাবার খোঁজ না পেয়ে সুহানারা ভেবেই নিয়েছিলেন, বাবা হয় তো আর বেঁচে নেই। আচমকাই, শুক্রবার রাতে সুহানা-জিশানরা তাদের বাবাকে ফিরে পেয়েছে। কী ভাবে তা সম্ভব হল? সে ইতিহাস দীর্ঘ।

    হাবড়া থানার কুমড়া পাঁচঘড়িয়া এলাকার বাসিন্দা বছর পঞ্চাশের মহম্মদ জসিম মনসুরির কুমড়া বাজারে লেপ-তোষকের দোকান। ২০০৭ সালে স্ত্রী আফসানার মৃত্যুর পর থেকে কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। জসিমের বড়দা মহম্মদ হাসিম মনসুরি থাকতেন বিহারে। ২০০৯ সালে জসিম বিহারে যান। সেখানে কয়েক দিন থেকে ভাগ্নে সমশেরের সঙ্গে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে শিয়ালদহ স্টেশনে জসিমকে দাঁড়াতে বলে সমশের শৌচাগারে যান। ফিরে এসে আর জসিমকে খুঁজে পাননি। ভয়ে সে কথা বাড়ির কাউকে জানাননি সমশের।

    এ দিকে, জসিমের বাড়ির লোকজন ভেবেছিলেন, জসিম বিহারে আছেন। তিন মাস হয়ে গেলেও জসিম বাড়ি না ফেরায় বিহারে জসিমের খোঁজ নেন জসিমের মেজদা জাকির হোসেন। তিনিও থাকেন কুমড়া এলাকায়। তাঁরা জানতে পারেন, জসিম অনেক দিন আগে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন।

    সমশেরকে চেপে ধরলে সে সব খুলে বলে। শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। দীর্ঘ দিন খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে একটা সময়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন জাকিররা। ধরেই নেন ভাইকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। সে হয় তো বেঁচেই নেই।

    কুমড়া বাজারে জাকিরের লেপ-তোষকের দোকান আছে। গত মঙ্গলবার হাবড়া থানার পুলিশ তাঁর দোকানে গিয়ে ভাইয়ের নাম-ঠিকানা জানতে চাই। এত দিন পরে কেন পুলিশ ভাইয়ের কথা জানতে চাইছে, বুঝতে পারেননি জাকির। পুলিশ আশ্বস্ত করে, ভয়ের কিছু নেই। বুধবার থানায় দেখা করুন।

    সেই মতো বুধবার জাকিররা থানায় যান। পুলিশ তাঁকে জসিমের ছবি দেখায়। ভাইকে চিনতে পারেন তিনি। পুলিশ জানায়, ভাই সুস্থ আছেন। কলকাতার বেলেঘাটা এলাকায় একটি ভরঘুরে হোমে আছেন। বৃহস্পতিবার জাকিররা সেই হোমে যান। ভাইকে দেখে চিনতে পারেন। ভাইও দাদাকে চিনতে পারেন। জড়িয়ে ধরে দু’জনেই কেঁদে ফেলেন। নিয়মকানুন মেনে জসিমকে শুক্রবার বাড়ি ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

    কী ভাবে ওই ভবঘুরে হোমে ঠাঁই হয়েছিল জসিমের?

    জাকির জানান, হোম কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জানতে পেরেছেন, ২০১২ সালের অগস্ট মাসে লালবাজারের পুলিশ রাস্তা থেকে উদ্ধার করে জসিমকে এখানে ভর্তি করে
    দিয়েছিল। জসিম তখন কথাবার্তা বলতে পারতেন না। দীর্ঘ দিন চিকিৎসার পরে সম্প্রতি কথা বলতে শুরু করেন। চিকিৎসককে এক দিন নাম, বাড়ির ঠিকানা জানান।

    হোমে সকলে তাঁকে ‘পঞ্চু’ বলে ডাকতেন। পরে হোম কর্তৃপক্ষের তরফে হাবড়া থানায় যোগাযোগ করা হয়।

    জসীমের বাড়িতে এখন উৎসবের মেজাজ। পাড়া-প্রতিবেশীদের মিষ্টি খাওয়ানো হচ্ছে। পুরনো মানুষজনকে জসিম চিনতে পারছেন, গল্পগুজব করছেন। যদিও এখনও পুরো সুস্থ নন। জাকির বলেন, ‘‘ভাইকে ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আল্লার কৃপায় ফিরে পেয়েছি।’’

    সুহানা বলে, ‘‘জন্মের পর থেকেই বাবা-মা কারও আদর-ভালবাসা পাইনি। বাবাকে ফিরে পেয়ে খুব আনন্দ হচ্ছে।’’ জিশান বলেন, ‘‘বাবার মুখটা আবছা চোখের সামনে ভাসত। কত দিন ভেবেছি, বাবা ফিরে আসবে। তারপর একটা সময়ে ভুলেই গিয়েছিলাম। এ বার যখন বাবাকে ফিরে পেয়েছি, আর চোখের আড়াল হতে দেব না।’’

    জসিমের কথায়, ‘‘বাড়ি ফিরে বড্ড আনন্দ হচ্ছে’’— কথা বলতে বলতেই চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে জল।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)