• ইভিএম কতটা নির্ভরযোগ্য
    আনন্দবাজার | ২৩ এপ্রিল ২০২৪
  • লোকসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণা হতেই আবার সেই পুরনো প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে— যে যন্ত্রে বোতাম টিপে ভোট দেওয়া হবে, সেই ইভিএম (ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন) কতটা নির্ভরযোগ্য? ২০১৯ সালের আগে, সুপ্রিম কোর্টে ইভিএম-সংক্রান্ত বেশ কিছু জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছিল। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি বিষয়টাকে আমল দিতে চাননি। মামলাগুলো তখনকার মতো খারিজ হয়ে গেলেও, এ বারের নির্বাচনের আগে নতুন করে মামলা দায়ের হয়েছে। এখনও অবধি খবর, সুপ্রিম কোর্ট সেই মামলাগুলো না শুনেই খারিজ করেনি। বরং শীর্ষ আদালতের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের কাছে চিঠি লিখে প্রশ্ন করা হয়েছে, ইভিএম এবং ভিভিপ্যাট-এর ফলাফল মিলিয়ে দেখে নির্বাচনের ফল ঘোষণা হবে না কেন? যদি পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ করে চব্বিশ লক্ষ ভিভিপ্যাট যন্ত্র কেনা যায়, তা হলে তার স্লিপ গোনা হবে না কেন? এই উত্তর দিতে নির্বাচন কমিশনকে আগামী ১৭ মে অবধি সময় দিয়েছে আদালত। ও দিকে মামলাও চলবে।

    বারংবার ইভিএম নিয়ে এত প্রশ্ন ওঠে, তা-ও নির্বাচন কমিশন এই বিষয়ে কেন উচ্চবাচ্য করে না? কমিশনের বাঁধা উত্তর, সব ঠিক আছে, কোনও যান্ত্রিক সমস্যা নেই। কমিশনের কর্তাদের যেন একটাই কাজ— বড় বড় বিজ্ঞাপন দিয়ে ঘোষণা করা, এই ইভিএম দিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়া কারও পক্ষে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। ইভিএম হ্যাকিং করা সম্ভব নয়। গত নির্বাচনে সেই বিজ্ঞাপনে আরও একটি কথা তাঁরা যোগ করেছিলেন। বলেছিলেন, ইভিএমের সঙ্গে ভিভিপ্যাট অর্থাৎ ‘ভোটার ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেল’-কে সংযোগ করানোর মধ্যে দিয়ে নির্বাচকদের মনের সন্দেহ দূর করা সম্ভব। একটি ইভিএম মেশিনে যখন এক জন নির্বাচক ভোট দেন, তখন যে-হেতু তাঁর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, তিনি তাঁর পছন্দমতো প্রার্থীকেই ভোট দিতে পেরেছেন কি না, তাই নির্বাচন কমিশন ওই ভিভিপ্যাট মেশিনকে ইভিএমের সঙ্গে সংযুক্ত করার কথা বলে। ভিভিপ্যাট যন্ত্র থেকে একটি কাগজের স্লিপ বা টুকরো বেরিয়ে আসবে, যা দেখে ইভিএমের স্বচ্ছতা বোঝা সম্ভব হবে।

    ২০১৩ সালে ভিভিপ্যাট যন্ত্র প্রথম চালু করা হয় পরীক্ষামূলক ভাবে। তার পরে ২০১৭ সাল থেকে সমস্ত নির্বাচনে ওই যন্ত্রের ব্যবহার প্রচলন করে নির্বাচন কমিশন। যে দিন থেকে এই ব্যবস্থা চালু হয়, এবং এই যন্ত্র থেকে প্রিন্ট-করা কাগজ বেরোনো শুরু হয়, সে দিন থেকেই দাবি ওঠা শুরু হয় যে, ইভিএম-এ প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে ওই কাগজ মিলিয়ে দেখে, তবে নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হোক। নির্বাচন কমিশন ২০১৮ সালে স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে চায়, ঠিক কতগুলো যন্ত্র থেকে প্রাপ্ত কাগজ গুনতে হবে, যাতে সবাই সন্তুষ্ট হয়। ওই পরিসংখ্যানবিদেরা কী পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা জানা যায়নি। তবে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নেয়, যে কোনও বিধানসভার একটি যন্ত্র থেকে প্রাপ্ত স্লিপ এবং ইভিএম-এর ভোট মিলিয়ে দেখা হবে। সুপ্রিম কোর্টেরই আর একটি রায়ের ভিত্তিতে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে ওই সংখ্যাকে এক থেকে বাড়িয়ে পাঁচ করা হয়। সেই সঙ্গে এ-ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, নির্বাচন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত রিটার্নিং অফিসারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ঠিক করা হবে কোন পাঁচটা যন্ত্র গোনা হবে।

    ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে সমস্ত ভিভিপ্যাট স্লিপ গোনার দাবি উঠেছে। ইতিপূর্বে সর্বোচ্চ আদালতে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছিল, এক-একটি মেশিন থেকে এই কাগজ মিলিয়ে দেখতে এক ঘণ্টা সময় লাগে, তাই সমস্ত মেশিন গুনতে হলে ফলাফল জানতে অনেক সময় লেগে যাবে। মিলিয়ে দেখার কাজটা করতে আরও বেশি কর্মীর প্রয়োজন পড়বে। প্রতি নির্বাচনে যে ভাবে বুথের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে এই কাজ প্রায় অসম্ভব।

    তবে প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার এসওয়াই কুরেশি সম্প্রতি একটি প্রশ্ন তুলেছেন। তা হল, নির্বাচন কমিশন যেখানে আগামী তিন বছরের মধ্যে ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ করতে পারবে বলে সম্মতি জানিয়েছে, কয়েক বছর আগেও মাত্র কুড়ি দিনে যে কমিশন ৫৪৩টি সংসদীয় ক্ষেত্রের নির্বাচন করতে পারত, সেখানে এই কাজটা করতে কমিশন কেন এত দ্বিধান্বিত? এই স্বচ্ছতা দেখানো গেলে তো শেষ পর্যন্ত তা ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্যেই ভাল।

    এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে এমন সময়ে, যখন নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক চলছে। এমনিতেই প্রচারের সময়ে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশন শাসক দলের আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ করে থাকছে। যখন তাদের প্রথম দায়বদ্ধতার জায়গা হওয়ার কথা ছিল ভারতীয় নির্বাচকমণ্ডলী, তখন তারা দায়বদ্ধতা দেখাচ্ছে শাসক দলের কাছে। ফলে ভোট গোনার ক্ষেত্রে কমিশন কী ভূমিকা নেবে, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিতে বাধ্য। সেই কারণেই নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে দাবি ওঠা উচিত— সমস্ত ভিভিপ্যাট স্লিপ গুনে তবে ভোটের ফল ঘোষণা করতে হবে। ভবিষ্যতের গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে এটাই সময়ের দাবি।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)