• অসমের একমাত্র ডিটেনশন সেন্টারে ‘বন্দি’র সংখ্যা ১৯৯! এনআরসির উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন
    বর্তমান | ১৯ এপ্রিল ২০২৪
  • রাহুল চক্রবর্তী, গোয়ালপাড়া: মোবাইল ফোনটা বার করুন। ক্যামেরা থাকলে জমা দিন। খাতায় নিজের নাম, ঠিকানা লিখুন।’ এসব নিয়ম মানার পর ধেয়ে এল একগুচ্ছ প্রশ্ন। কোথা থেকে এসেছেন, কেন এসেছেন, কী দরকার? এতসব ঝক্কি পেরিয়ে মিলল ভিতরে ঢোকার অনুমতি। খুলে গেল এই মুহূর্তে অসমে ‘অনুপ্রবেশকারী’দের জন্য একমাত্র স্থায়ী ট্রানজিট ক্যাম্পের (পূর্বতন ডিটেনশন সেন্টার) পেল্লাই লোহার দরজা!

    ক্যাম্প না বলে কারাগার বললে অবশ্য খুব একটা অত্যুক্তি হয় না! ২৬ বিঘা জমির চারপাশ কাঁটাতার সহ উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। ওয়াচ টাওয়ার থেকে সশস্ত্র পুলিসের শ্যেনদৃষ্টি। আগন্তুককে এক পলক দেখে নিয়ে আড়াল খুঁজে নিচ্ছেন আবাসিকরা। সবার চোখেই সন্দেহ, ভয়। কারও সঙ্গে কথা বলার অনুমতি নেই। জানা গেল, ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলতে হলে প্রশাসনের শীর্ষমহল থেকে বিশেষ অনুমতি আনতে হবে। ক্যাম্প ইনচার্জের দেওয়া তথ্য বলছে, মঙ্গলবার পর্যন্ত এখানে ‘বন্দি’র সংখ্যা ১৯৯। তেজপুর, গোয়ালপাড়া, কোকরাঝাড়, শিলচর, জোড়হাট, ডিব্রুগড়ে ডিটেনশন ক্যাম্প ছিল আগে। সেখানে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গেই ‘অনুপ্রবেশকারী’দের রাখা হতো। এখন এটাই একমাত্র ট্রানজিট ক্যাম্প। ১৯৯ জনের মধ্যে ১২৩ জন পুরুষ, ৪৪ জন‌‌ মহিলা ও ৩২ জন শিশু। এদের মধ্যে অসম রাজ্যের ডি-ভোটার যেমন রয়েছেন, তেমন আছেন বাংলাদেশ, মায়ানমার থেকে আসা লোকজনও। ডি ভোটার বা সন্দেহজনক ভোটারদের নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকায় ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তাঁদের সমস্যার দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তাই যদি হয়, সেক্ষেত্রে ক্যাম্পে বন্দির সংখ্যা আরও কমবে।

    এখানেই প্রশ্ন, কিছু মানুষকে যাবতীয় নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দেশের ‘সুদিন’ ফেরানোর খোয়াব দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত কি এই মিলল? তাহলে কতজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে চিহ্নিত করে দেশ থেকে অপসারিত করা গেল? নথিপত্রে কিছু সমস্যা বা আইনি জটিলতার কারণে কেন লক্ষ লক্ষ মানুষকে অহেতুক নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার ভয় দেখানো হল? শেষ পর্যন্ত লাভ হল কার? অসমে এসব নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ তেমন কিছু বলছেন না। কিন্তু লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে প্রশ্নগুলি বাতাসে ভাসছে। শুরুতে অসমের ছ’টি ডিটেনশন ক্যাম্পে হাজার তিনেকের বেশি মানুষকে রাখা হয়েছিল। সিংহভাগ ভুক্তভোগী অনেক হেনস্তা ও হয়রানি সহ্য করে শেষ পর্যন্ত নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পেরেছেন। গুয়াহাটি শহর থেকে ১৭৫ কিলোমিটার দূরের শহর বঙ্গাইগাঁও। সেখান থেকে আরও ৭০ কিলোমিটার গেলে পাহাড়ঘেঁসা গোয়ালপাড়ার মাটিয়াতে অসমের একমাত্র ডিটেনশন সেন্টার। স্থানীয় সূর্যগিরি পঞ্চায়েতের বাসিন্দা, পেশায় দর্জি মফিজুল ইসলাম বললেন, ‘এখানে হিন্দু মুসলিম, নেপালি অনেকের বসবাস। আগে সিএএ, এনআরসি নিয়ে অনেক অশান্তি হয়েছে। এখন পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত। তবে আমরা প্রত্যেকে চাই, সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান হোক।’ সূর্যগিরি মোড় থেকে খানিকটা এগলে নেপালিখুটি। সেখানে এনআরসি নিয়ে লোকজনের কথাবার্তায় কোনও উদ্বেগের চিহ্ন নেই। চোখে পড়ল প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনার হোর্ডিং। 

    ট্রানজিট ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, এখানে শিশুদের  পড়াশোনা করানো হয়। ২ জন‌ করে চিকিৎসক ও নার্স ২৪ ঘণ্টা থাকেন। অসুস্থদের প্রয়োজনে গোয়ালপাড়া বা গুয়াহাটি নিয়ে যাওয়া হয়। তবে সব ক্ষেত্রেই থাকে কড়া নজরদারি। আবাসিকদের ভাত, রুটি, তরকারি, বিশেষ দিনে মাছ ও মাংস দেওয়া হয়। রয়েছে টিভি, ক্যারাম, লুডো, ফুটবল, ভলিবল খেলার মাঠ। চুল কাটার জন্য সপ্তাহে দু’দিন নাপিত আসে। স্থানীয় চায়ের দোকানের মালিক ফনিন্দ্র কলিতা বললেন, ‘সেন্টারের বাইরে কোনও বিদেশি পা ফেলেন না।’
  • Link to this news (বর্তমান)